খোয়াই নদীর তীরে : ডিসির ডায়েরি ৪০
পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতা রোধ করা সহজ বিষয় যে নয় তা মাঠ প্রশাসনে কাজ করে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি
ব্যবসায়ীদের সুমতি ছাড়া এটা কিছুতেই সম্ভব না
আতাউর রহমান কানন
২৮ জুন ২০০৭, বৃহস্পতিবার। সকাল সাড়ে ৯টায় ট্রেজারি ভেরিফিকেশনে যাই। প্রতিবছর জুনের শেষ কর্মদিবসে এই ভেরিফিশেন হয়। আগামী দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি হওয়ায় আজই এই ট্রেজারি ভেরিফিকেশন। আমার অফিসের সকল অফিসার সকাল থেকেই এ কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রেজারি অফিসার আগে থেকেই অনেককিছু গুছিয়ে রেখেছেন। আজ ট্রেজারিতে গচ্ছিত সরকারি স্ট্যাম্প ও অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ সরেজমিন যাচাই করা হয়। ট্রেজারিতে ২৫ লাখ টাকার একটি সিলগালাকৃত ছোট কার্টুন রয়েছে। জেলায় আমার যোগদানের আগে অবৈধভাবে এ টাকা পরিবহনের দায়ে এসএ পরিবহণ হতে জব্দ করা হয়। মামলা চলমান থাকায় মূল মালিক এখনও সাব্যস্ত হয়নি।
সকাল সাড়ে ১০টায় ‘বার্ড ফু¬’ এবং এর প্রতিকার’ শীর্ষক আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। এই বার্ডফ্লু সম্পর্কে আগে অনেক কিছুই জানা ছিল না। আজকের সেমিনারে তা জানা হলো। দেশে পোল্ট্রি ফার্মের বিস্তার ঘটায় এই রোগেরও বিস্তার ঘটেছে। অনেক পোল্ট্রি ফার্মের মালিক পথে বসে গেছেন। এই রোগের বিস্তার রোধ করা না গেলে তা মানুষের দেহেও নাকি প্রবেশ করে সর্বনাশ ঘটাবে।
২৯ জুন ২০০৭, শুক্রবার। সকাল ১০টায় আমার বাসভবনে সরকারি নির্দেশনামতে জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন বিষয়ক সভা করি এবং সর্বসম্মতিক্রমে কমিটির একটি খসড়া রূপরেখা দাঁড় করাই।
আজ সকালে হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন সপরিবারে সার্কিট হাউজে উঠেছেন। সকাল সাড়ে ১১টায় তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে যাই। সেখান থেকে ফিরে স্টাফ কোয়ার্টার জামে মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ পড়ি।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল বিডিআর ক্যাম্পে ১ রাইফেল ব্যাটালিয়নের ২১২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর প্রীতিভোজে যোগদান করি। সেখান থেকে রাত সাড়ে ৮টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে সাড়ে ১০টায় ঢাকার বাসায় পৌঁছি। আগামী ১-৩ জুলাই তিন দিনব্যাপী প্রতিরক্ষা অধিদপ্তরে জেলা প্রশাসকদের সাইফার (গুপ্তসংকেত) ট্রেনিং হবে। আমি সে ট্রেনিংয়ের অংশগ্রহণের জন্য মানোনয়নপ্রাপ্ত।
৪ জুলাই ২০০৭, বুধবার। তিন দিনব্যাপী সাইফার ট্রেনিং গতকাল সমাপ্ত হওয়ায়, আজ সকালে ঢাকায় কিছু হাল্কাপাতলা কাজ সেরে হবিগঞ্জের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করি। বিকেল ৩টায় হবিগঞ্জ পৌঁছে অফিসের কাজকর্ম নিয়ে বসি। আমার অনুপস্থিতিতে বিকল্প কর্মকর্তা এডিসি জেনারেল শুধু যা না করলেই নয়, সেসব কাজ করে বাকি কাজ আমার জন্য তুলে রেখেছেন। আমি ৭টা পর্যন্ত কাজ করে বাসায় ফিরি। এরপর সাড়ে ৮টায় টেনিস খেলতে যাই। মাত্র কয়েকটা দিন মাঠে আসিনি- এতেই মাঠটি নতুন নতুন লাগছিল। তবে আবহাওয়াটা ফুরফুরে থাকায় খেলে বেশ আনন্দই পেলাম। রাত ১০টায় বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে ডিনার শেষে বিছানায় গেলাম।
৯ জুলাই ২০০৭, সোমবার। বিগত কদিন অফিস-বাসা-অফিস করেই কেটে গেল। বাইরে কোনো প্রোগ্রাম ছিল না। আজ সকাল ১০টায় রুটিন ট্যুরের অংশ হিসেবে বাহুবল উপজেলাধীন মিরপুরস্থ আলিফ-সোবহান ডিগ্রি কলেজের গভর্নিং বডির সভায় যোগদান করি। সেখানের সভা শেষে সাড়ে ১১টায় নবীগঞ্জ উপজেলাধীন পানিউমদা ইউনিয়ন ভূমি অফিস পরিদর্শনে যাই। ইউএনও নবীগঞ্জও সেখানে পূর্ব হতে উপস্থিত ছিলেন। সেখানের কাজ সেরে ইউএনও-সহ পানিউমদা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যাই। পরিষদ চেয়ারম্যান তাঁর পারিষদবর্গ নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। কার্যালয়টি পরিদর্শন করি এবং ইউনিয়ন পরিষদের আয়োজিত সৌজন্য সভায় বক্তব্য রেখে বিকেল আড়াইটায় নিজ অফিসে ফিরে এসে লাঞ্চ সেরে কাজকর্ম করি।
১১ জুলাই ২০০৭, বুধবার। সকাল ৯টায় বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত রেলি নেতৃত্ব দিই। রেলি শেষে সকাল ১১টায় বানিয়াচং উপজেলায় গিয়ে উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত বৃক্ষমেলা-২০০৭ উদ্বোধন করি। বেশ সাজানোগোছানো মেলার স্টলসমূহ, আর সেইসঙ্গে উপচেপড়া দর্শক-ক্রেতা। উপজেলায় যে এত সুন্দর বৃক্ষমেলার আয়োজন করা যায় তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। এরপর ইউএনও অফিস, এসি (ল্যান্ড) অফিস ও থানা দর্শন করে বিকেল ২টায় নিজ অফিসে ফিরে আসি।
১৪ জুলাই ২০০৭, শনিবার। আজ সারাদিন বাসাতেই ছিলাম। তবে বেশ কয়েকজন ভিজিটর বাসায় এসে আমার সময় নষ্ট করে গেছেন। ছুটির দিন বলে যেন ডিসির কিছু থাকতে নেই! জনবান্ধব উন্নয়ন প্রশাসনের যুগ চলছে। এখন আর ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র নেই। জনগণের কাছে যেতে হবে, তাদের শুনতে হবে- তবেই না জনসেবক। আমিও তাই জনবান্ধব প্রশাসনে বিশ্বাসী।
বিকেল ৫টায় হবিগঞ্জের শিরিষতলায় এটিএন বাংলার ১০ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান করি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে হবিগঞ্জ জেলায় শিশুদের মধ্যে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ১০১ জন শিশু এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। আলোচনা পর্ব শেষে বিভিন্ন গ্রুপের বিজয়ী শিশুদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করি।
১৬ জুলাই ২০০৭, সোমবার। সকাল সোয়া ৯টায় হবিগঞ্জ জেলা জাতীয় মৎস্যপক্ষ উদ্বোধন করে রেলিতে অংশগ্রহণ করি। সেখান থেকে ১০টায় জেলা কারাগার পরিদর্শনে যাই। কারাগার পরিদর্শন শেষে হবিগঞ্জ শহরের নিউফিল্ড ময়দানে জেলা ফল ও বৃক্ষমেলা-২০০৭ এ প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কৃষি ও বন বিভাগ যৌথভাবে বরাবরের ন্যায় এই মেলার আয়োজন করেছে। ব্যাপক আয়োজন। নানা রূপে সজ্জিত স্টলসমূহে ফল-ফুল আর গাছের চারার সমারোহ দর্শক-ক্রেতাদের মুগ্ধ করে। মেলা উদ্বোধন করে সাড়ে ১২টায় অফিসে ফিরে আসি।
বিকেল ৪টায় হবিগঞ্জের জগন্নাথ দেবের রথ যাত্রায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। রথযাত্রা মেলায় এসে আমার ধামরাইয়ের শ্রী যশোমাধবের রথযাত্রা ও মেলার কথা মনে পড়ল। সে মেলার সাথে এ মেলার কোনো তুলনাই চলে না। হিন্দুদের ইসকন সম্প্রদায় এ রথযাত্রার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আমি রথযাত্রা উদ্বোধন করে বিকেল ৫টায় হবিগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতি কর্তৃক আয়োজিত ‘দ্রব্যমূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা বিষয়ক’ মতবিনিময় সভায় যোগদান করি। আমার সাথে সেনা ইউনিটের সিও এবং পুলিশ সুপারও এসব অনুষ্ঠান ও সভায় যোগদান করেন।
আজ সকাল সাড়ে ৭টায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী (১৯৯৬-২০০১ সাল) শেখ হাসিনাকে সরকার গ্রেপ্তার করে। জানা যায়, ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরী ও কাজী তাজুল ইসলাম ফারুকের পৃথকভাবে ইতঃপূর্বে দায়েরি সাজানো চাঁদাবাজির মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। দেশ কোনদিকে যাচ্ছে মাঠ প্রশাসনে থেকে কিছুই বুঝতে পারছি না!
১৮ জুলাই ২০০৭, বুধবার। আজ সারদিন অফিসেই অবস্থান করি। কাজ আর ভিজিটরদের সাক্ষাতদানেই সময় কেটে যায়।
এখন ডিভিডির চল। এতে গান শোনা ও মুভি দেখা যায়। আমি কিনি কিনি করে আর কেনা হয়নি। আজ রাত আটটায় হবিগঞ্জ শহরের আমার পূর্বপরিচিত সাংবাদিক শামীমের ইলেকট্রনিক্সের দোকান থেকে জেলা নাজির আবদুস সামাদকে পাঠিয়ে একটি ডিভিডি (FUNAI Brand) ক্রয় করে আনাই। অবসরে গান শোনার একটি যন্ত্র কিনে বেশ আনন্দবোধ হলো।
রাতে মুষলধারায় বৃষ্টি নামে। অমাবস্যার নিকষ কালো রাত। চারদিক নিঝুম-নিথর। রাতের পাখিরও কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি লো ভলিউমে রবীন্দ্র সংগীত ছেড়ে বিছানায় গা বিছিয়ে দিলাম। কখন ঘুমের দেশে চলে গেছি বুঝতে পারিনি। পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগেও দেখি বৃষ্টি ঝরছে। আমার আজমিরীগঞ্জ ট্যুরে যাওয়ার প্রোগ্রাম ছিল। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়ার কারণে সে প্রোগ্রাম বাতিল করা হয়। বৃষ্টির মধ্যে সারাদিন অফিসেই কাজকর্ম করে কাটাই।
২২ জুলাই ২০০৭, রবিবার। বিগত কয়েকদিন বৃষ্টিভেজা দিন ছিল। আজ সকাল থেকেই মেঘেরা বিদায় নেওয়ায় সূর্য ঝলমলিয়ে হেসে ওঠে। আমি সকাল ১০টায় জেলা হাসপাতালের সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে যাই। সেখানে আজ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা ছিল। সে সভা শেষে নিজ অফিসে এসে সকাল সাড়ে ১১টায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যসংক্রান্ত কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করি। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতা রোধ করা সহজ বিষয় যে নয় তা মাঠ প্রশাসনে কাজ করে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। মোটাদাগে ব্যবসায়ীদের সুমতি ছাড়া এটা কিছুতেই সম্ভব না। আর বাজার নিয়ন্ত্রণকারী এসব ব্যবসায়ীগণের অনেকেই এখন দৌড়ের ওপর থাকায়, তাঁরাও যে সরকারের ওপর এক হাত নিচ্ছেন তা সরকারের কাছেও সুস্পষ্ট হচ্ছে। (চলবে…)