পুলিশ কর্মকর্তাকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ থানার সামনে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়
স্টাফ রিপোর্টার \ বানিয়াচংয়ে পুলিশের গুলিতে ৬ জন নিহত হওয়ার জেরে প্রায় ১০ ঘণ্টা থানা ঘেরাও করেন স্থানীয় জনতা। সোমবার দিবাগত রাত দুইটায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ থানার সামনে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে। এদিকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ায় বানিয়াচং থানার সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি উদ্ধার হওয়া ১৫ পুলিশ সদস্যকে জেলা পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে।
সোমবার (৫ আগস্ট) দুপুরে উপজেলার এলআর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে জড়ো হন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কয়েক শ’ লোক। পরে তাঁরা একটি মিছিল নিয়ে বড় বাজার হয়ে থানার সামনে দিয়ে রওনা হন। পথে ঈদগাহ এলাকায় তাঁদের বাঁধা দেয় পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের কথা-কাটাকাটি হয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই ৩ জন, হাসপাতালে আরও ৩ জনসহ মোট ৬ জন নিহত হন।
নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে থানার সামনে জড়ো হন। একপর্যায়ে কয়েক হাজার মানুষ থানা ঘেরাও করেন। শুরু হয় ইটপাটকেল নিক্ষেপ। একপর্যায়ে থানা ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় থানার ভেতরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ পুলিশের ১৫ থেকে ১৬ সদস্য আটকা পড়েন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের ১০ থেকে ১৫ জন নেতা-কর্মীও আটকা পড়েন। তাঁরা থানা ঘেরাওয়ের আগে বিক্ষোভকারীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন। বিক্ষোভকারীদের ধাওয়ায় থানায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। থানা ঘেরাওয়ের খবর পেয়ে বেলা তিনটার দিকে জেলা সদর থেকে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। কিন্তু কোনোভাবেই সেনাবাহিনী থানা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না। এভাবে সময় গড়িয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত ক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করে রাখেন। মধ্যরাতে হবিগঞ্জ থেকে বিএনপির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গউছসহ বেশ কিছু নেতা ঘটনাস্থলে গিয়ে লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু লোকজন কোন কথাই শুনছিলেন না। পরে ক্ষুব্ধ লোকজন রাত একটার দিকে সেনাবাহিনীকে প্রস্তাব দেন, আওয়ামী লীগ নেতা ও বানিয়াচং উত্তর-পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়া ও থানার উপরিদর্শক সন্তোষ দাশ চৌধুরীকে তাঁদের হাতে ছেড়ে দিতে। কিন্তু সেনাবাহিনী সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। পরে সেনাবাহিনী জানায়, থানার ভেতরে ওই আওয়ামী লীগ নেতা নেই। পরে জেলা বিএনপি ও স্থানীয় সুশীল সমাজের অনুরোধে লোকজন শান্ত হন। রাত ২ টার দিকে থানার দ্বিতীয় তলায় অবরুদ্ধ পুলিশ সদস্য ও নেতাদের উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁদের সেনাবাহিনীর গাড়িতে ওঠানোর সময় উপপরিদর্শক সন্তোষ দাশ চৌধুরীকে উপস্থিত লোকজন ছিনিয়ে নিয়ে সবার সামনে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে বানিয়াচং বড় বাজার শহীদ মিনার মাঠে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ভোররাতে লাশ থানার সামনে এনে ফেলে রাখা হয়। মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে ক্ষুব্ধ লোকজন লাশ থানার সামনে একটি আকাশিগাছে ঝুলিয়ে রাখে। দিনভর হাজারো মানুষ লাশ দেখতে থানা প্রাঙ্গণে ভিড় করেন। এদিকে গাছে লাশ ঝোলানোর খবর পেয়ে গতকাল মঙ্গলবার বেলা ২ টায় সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে।
হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার আক্তার হোসেন বলেন, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর ওই থানার পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে। বর্তমানে থানায় যাঁরা কর্মরত ছিলেন, তাঁদের পুলিশ লাইন্সে যুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে নিহত ৬ জন, জনতার হাতে নিহত স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী ও মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী সোহেল আখঞ্জীসহ ৭ জনের জানাজা স্থানীয় এলআর স্কুলমাঠে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। পরে লাশগুলো ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করেন স্বজনরা।