ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর গ্রেফতার হওয়া ইউএনওকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়
আতাউর রহমান কানন
৩০ মে ২০০৭, বুধবার। আমি সকাল থেকেই অফিসে ছিলাম। বিকেল ২টায় সেনাবাহিনীর কর্নেল মনির ফোনে জানান যে, সদর উপজেলার ইউএনওকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে হাতেনাতে ধরা হয়েছে।
আমি কিছুটা নির্বাক হয়ে ভাবলাম, চারদিকে ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চলছে। আমিও বিভিন্নভাবে বয়ান করে যাচ্ছি। তাতে লাভ কী হচ্ছে? আসলে চোরে শোনে না ধর্মবাণী। ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে কর্নেলকে বললাম, কীভাবে কী হলো?
তিনি বললেন, পূর্ব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ফাঁদ পাতা হয়েছিল। ঘুষের টাকা টেবিলে রেখে গুনে নিচ্ছিলেন। যাক, আপনার কাছে টুআইসি আরিফ নিয়ে যাচ্ছে, আপনি আইনি ব্যবস্থা নিন।
এর কিছুক্ষণ পরই ইউএনওকে আমার অফিসকক্ষে আনা হয়। আমি ইউএনওকে শুনি। সে জানায়, টাকাটা ইউএনওর বাসভবন মেরামত করার জন্য বরাদ্দকৃত টিআরের গম বিক্রির টাকা। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, বাসভবন মেরামতের জন্য প্রজেক্ট কমিটি আছে। সে কমিটির দায়িত্ব বাসা মেরামত করে ইউএনওকে বুঝিয়ে দেওয়ার। সে কমিটির বরাবরে বরাদ্দকৃত গম বিক্রির টাকা তার কাছে কেন- সে এর কোনো সদুত্তর দিতে পারে নি। আমি এডিসি জেনারেলকে ডেকে ঘটনাটি তদন্ত করে তাৎক্ষণিক একটি প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলাম। টেলিফোনে বিষয়টি সংস্থাপন সচিবকে জানালাম। তিনি করণীয় সম্পর্কে আমার সুপারিশ চাইলেন। আমি বললাম, স্যার, শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে। তবে আপাতত তাকে ওএসডি করুন। আমি তাকে আজই রিলিজ করে দিতে চাই।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই ইউএনও’র ওএসডি আদেশ চলে আসে। আমি তাকে রিলিজ করে দিই। আমার কার্যক্রম সবই সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা অবজার্ভ করে উচ্চপর্যায়ে টাইম-টু-টাইম অবহিত করছিলেন। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ইউএনওকে আমার অফিসে রেখে চলে যান। মনে হলো আমার গৃহীত কার্যক্রমে তাঁরা সন্তুষ্ট।
সেনাবাহিনী চলে গেলে ইউএনওকে এসি ল্যান্ড বরাবর চার্জ দিয়ে দ্রুত হবিগঞ্জ ছেড়ে চলে যেতে বলি। আর এনডিসিকে একটি গাড়ি দিতে বলে দিই। ইউএনও সুবোধ বালকের মতো ‘আচ্ছা স্যার’ বলে চলে যায়। আমিও কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসি।
মাগরিবের নামাজ পড়ে বাসভবনের অফিসে বসে কাজ করছিলাম। কিছুক্ষণ পর ইউএনও সেখানে আসে। তাকে দেখে আমি বলি, তুমি এখনও যাও নি?
সে বলে, স্যার, চার্জ দিয়ে এসেছি। চলে যাওয়ার আগে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।
আমি বললাম, দেখা-সাক্ষাৎ বাদ দিয়ে দ্রুত চলে যাও।
‘আচ্ছা স্যার’ বলে সে বেরিয়ে যায়। রাত ১২টায় সেনাবাহিনীর টুআইসি মেজর আরিফ আমাকে ফোনে জানান যে, স্যার সরি, ইউএনও সাহেবকে যে গ্রেপ্তার করতে হচ্ছে। হাইকমান্ডের নির্দেশ।
আমি কাঁচা ঘুম ভাঙা কণ্ঠে বললাম, তাকে কোথায় পাবেন? সে তো চলে গেছে।
মেজর আরিফ বললেন, না স্যার, তিনি বাসাতেই আছেন।
এ সংবাদে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। চুরি তো চুরি, আবার সিনা জুরি! আমি বললাম, থাকলে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান।
সেনাবাহিনী তাকে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে সারারাত তাদের ‘ক্যাম্প’ সার্কিট হাউজে রাখে।
পরদিন সকালে এনডিসি একবার সার্কিট হাউজে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করে এসে আমাকে জানায় যে, সে নাকি আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি এ সংবাদে এনডিসিকেই সামনে পেয়ে মৃদু ভর্ৎসনা করি।
পরে এডিসি জেনারেলের কাছে জানতে পারি যে, গত সন্ধ্যারাতে আমার সঙ্গে দেখা করে সে এনডিসির দেওয়া গাড়ি রেখে তার গাড়ি নিয়ে শহর ঘুরে বেড়ায়। রূপালি ম্যানশন, আমিরচান শপিং মলে গিয়েও কেনাকাটার ভণিতায় পরিচিত লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এরপর উপজেলার ক্লাবের মাঠে অফিসারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও ব্যাডমিন্টন খেলে বাসাতেই অবস্থান করে। এসব কার্যকলাপ দিয়ে সে বুঝাতে চেয়েছিল- তাকে ঘুষ কেলেঙ্কারির মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। প্রমাণিত না হওয়ায় সে এখন সসম্মানে মুক্ত।
দুপুরের দিকে দুদকের দায়েরি মামলায় সে হাজতে চলে যায়। আমি মামলার বিবরণসহ সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করলে, সেদিন বিকেলেই তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। বিভাগীয় কমিশনারের সাথে ঘটনা শেয়ার করলে তিনিও বেশ অবাক হন এবং আমাকে এ ধরনের কোনো কাজে ভবিষ্যতে আর না জড়াতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, কেউ নাবালক না; যে যতটুকু কাদায় নামবে, গায়ে ততটুকু কাদা লাগবে। তোমার আমার করণীয় কিছু নেই।
৩১ মে ২০০৭, বৃহস্পতিবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। অফিসারদের আমার অফিসকক্ষে সালাম দিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত সভা করি। সভায় কাজকর্মের খোঁজখবর নিই। সদর ইউএনও’র ঘটনায় সবাই যেন কেমন মনমরা। তাদের চা-নাশতায় আপ্যায়ন করে সরলপথে কাজকর্ম করার নির্দেশনা দিয়ে সভা শেষ করি। এরপর সকাল ১১টায় জেলা পরিষদ মিলনায়তনে গিয়ে ‘সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ ও শিক্ষার্থীদের আত্মকর্মসংস্থান’ বিষয়ক সভায় সভাপতিত্ব করি। সেখান থেকে বিকেল দেড়টায় নিজ অফিসে ফিরে দেখি বেশ ক’জন ভিজিটর সাক্ষাতের অপেক্ষায় আছেন। আমি তাঁদের সাক্ষাৎ দিয়ে লাঞ্চ করে অফিসের কাজকর্ম সেরে বিকেল সাড়ে ৫টায় বাসায় ফিরে আসি।
৭টায় কিবরিয়া মিলনায়তনে উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী ও হবিগঞ্জ সুরবিতান ললিকলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ওস্তাদ বাবর আলী খানের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সুরবিতান ললিতকলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত স্মরণসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করি। আজকের অনুষ্ঠানে বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন ওস্তাদ বাবর আলী খানের ছাত্র হবিগঞ্জের কৃতী সন্তান কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মহাসচিব নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী। স্মরণসভার আলোচনা শেষে এই আমন্ত্রিত গুণী অতিথিদের ক্রেস্ট উপহার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এরপর এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয় আমারই লেখা গান ‘সুরবিতানের সুরের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়–ক…’ সমবেত সংগীতের মাধ্যমে। এরপর বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনার পর সর্বশেষে পরপর কয়েকটি গান পরিবেশন করেন সুবীর নন্দী। অতিথি ও শ্রোতৃমন্ডলী বিমোহিত হয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন। রাত ১১টায় অনুষ্ঠান শেষ হয়েও যেন শেষ হয় না। (চলবে..)