আশ্চর্যের বিষয় কৃষি বিভাগের বিএসদের কৃষকগণ চিনেন না এবং তাঁরা কৃষকদের কাছে কোন পরামর্শ নিয়ে গিয়েছেন বলে কৃষকগণ স্মরণ করতে পারেন না

আতাউর রহমান কানন

১২ মে ২০০৭, শনিবার। সাপ্তাহিক ছুটির দ্বিতীয় দিনে আমি বাসাতেই ছিলাম। সকাল ৯টায় হবিগঞ্জের সুধীজন সাবেক পৌর মেয়র শহীদ চৌধুরী আমার বাসায় আসেন। তিনি হবিগঞ্জের মাছুলিয়ায় প্রবাসীদের অর্থায়নে নির্মাণাধীন ডায়াবেটিক ও জেনারেল হাসপাতালটি আমাকে দেখাতে নিতে এসেছেন। এর আগেও তিনি আমাকে বলেছিলেন কিন্তু আমি সময় দিতে পারিনি। আজ তাঁর সাথে বেরিয়ে গেলাম। ৬তলা ফাউন্ডেশনের ৩লার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ দেখলাম। খোয়াই নদীর তীরে মনোরম পরিবেশে এই স্থাপনাটিতে এ বছরই কার্যক্রম চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ বিশেষায়িত হাসপাতালের জন্য সরঞ্জামাাদি ও বেড ইতোমধ্যে প্রবাসী অনুদানে বিদেশ থেকে এসে পৌঁছেছে। আমাকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখানো হয়। হাসপাতালটি চালু হলে হবিগঞ্জের সহস্রাধিক ডায়াবেটিক ও সাধারণ মানুষ স্বল্পমূলে প্রয়োজনীয় উন্নত চিকিৎসা পাবেন- এমন আশা হবিগঞ্জবাসীর। এমন একটি মহতী কর্ম দেখে আমি বেশ আবেগাপ্লুত হলাম।
১৫ মে ২০০৭, মঙ্গলবার। আজ সকালে নবীগঞ্জ উপজেলায় গিয়ে চলমান এইচএসসি পরীক্ষা পরিদর্শন করি। কেন্দ্রসচিব জানান যে, নবীগঞ্জে এত সুন্দর পরিবেশ ও নকলমুক্ত পরীক্ষা নাকি এর আগে হয়নি। আমি সারা জেলাতে এমনই চাই বলে তাঁকে জানালাম। সেখান থেকে ইনাতগঞ্জ ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও কাজীরবাজার ইউনিয়ন ভূমি অফিস পরপর পরিদর্শন করি। ভূমি উন্নয়ন কর আদায় কার্যক্রম জোরদার করার জন্য তহসিলদারদের নির্দেশ দিই ।
নবীগঞ্জ থেকে নিজ অফিসে ফিরে বিকেল তিনটায় জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে বিশেষ সমন্বয় সভায় সভাপতিত্ব করি। সভা শেষে সন্ধ্যালগ্নে বাসায় ফিরে আসি।
১৯ মে ২০০৭, শনিবার। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার পারিবারিক প্রয়োজনে দুদিনের ছুটি নিয়ে ঢাকা এসেছিলাম। আজ সপরিবারে হবিগঞ্জ রওনা হওয়ার কথা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেটা জ্বরে পড়ায় আমি একাই সকালের নাশতা খেয়ে ঢাকা ত্যাগ করি। দুপুরে বাসায় ফিরে লাঞ্চ করে রেস্ট নিই। রাতে ডেনটিস্ট সুমনের ক্লিনিকে যাই। আজ রুট ক্যানেলকৃত দাঁতে ক্যাপ লাগানোর মাধ্যমে আমার দাঁতের দীর্ঘ সময়ের বিরক্তিকর চিকিৎসা এবারের মতো শেষ হয়।
২২ মে ২০০৭, মঙ্গলবার। সকাল ১০টায় মাধবপুর উপজেলার ছাতিয়াইন ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় পরিদর্শনে যাই। সেখানে ইউএনও মাধবপুর আমার আগমন সংবাদে আগে এসেই উপস্থিত ছিলেন। ইউপি চেয়ারম্যান মিনহাজ উদ্দিন চৌধুরী অফিস প্রাঙ্গণে জনসমাবেশেরও আয়োজন করেন, যা আমার ভাবনায় ছিল না। আমি একসময় মাধবপুর উপজেলায় ইউএনও থাকাকালে তিনি তখনও চেয়ারম্যান ছিলেন। সহজ সরল সজ্জন এই উচ্চশিক্ষিত চেয়ারম্যানের মধ্যে কিছুটা পাগলামি ভাব আছে। যাক, কী আর করা! আমি পরিদর্শন কাজ শেষ করে জনসমাবেশে বক্তব্য রাখি। এরপর ঐতিহ্যবাহী ছাতিয়াইন বাজার এলাকা দর্শন করে মাধবপুর ইউএনও অফিসে যাই। এ অফিস পরিদর্শন শেষে বিকেল ২টায় সদর দপ্তরে ফিরে আসি।
২৩ মে ২০০৭, বুধবার। আজ সকাল ১০টায় বানিয়াচং উপজেলায় যাই। সেখানে ইউএনও নিদের্শিত হয়ে কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। সম্মেলনে সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির ও এসপি আবদুল মান্নান যোগদান করেন। সম্মেলনে উপজেলার সকল ইউপি চেয়ারম্যান, কর্মকর্তা ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ যোগদান করেন। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে নিয়োজিত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা (প্রাক্তন ব্লক সুপারভাইজার সংক্ষেপে বিএস)গণও অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে উপজেলার কৃষকগণের অধিকাংশই উপস্থিত ছিলেন। কৃষকদের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে তাঁরাই যে দেশের প্রাণ সেসব বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে মতবিনিময় করা হয়। এখানে আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে, কৃষি বিভাগের বিএসদের কৃষকগণ চিনেন না এবং তাঁরা কৃষকদের কাছে কোনোরুপ পরামর্শ নিয়ে গিয়েছেন বলে কৃষকগণ স্মরণ করতে পারেন না। অথচ এদের সরকার বেতনভাতা দেন কৃষকদের কৃষি কাজে নানা পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের জন্য। মতবিনিময় সভা শেষে বিকেল ৩টায় সদর দপ্তরে ফিরে আসি।
২৫ মে ২০০৭, শুক্রবার। দুপুর ১২টায় শাহজীবাজারস্থ হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে যাই। সেখানে বড়লেখা থেকে কেয়ারটেকার সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টা তপন চৌধুরী আসেন। তাঁকে রিসিভ করি। গতকাল তিনি ঢাকা থেকে বড়লেখা যাওয়ার পথে বিকেল ৪টায় এই গ্যাসফিল্ডে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। আজ তাঁর জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লাঞ্চের পরপরই তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। আমি বাসায় ফিরে আসি।
বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত হবিগঞ্জ নজরুল একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত নজরুল জন্মজয়ন্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকি। এরপর বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে সুরবিতান ললিতকলা একাডেমিতে যাই। সেখানেও সাড়ে ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নজরুল জন্মজয়ন্তি অনুষ্ঠান হয়। সে অনুষ্ঠানেও আমি প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করি। আমার ইচ্ছা- অনিচ্ছার কোনো বিষয় যেন কাজ করছে না। এসব অনুষ্ঠানে আমাকে সময় দিতেই হচ্ছে। সোয়া ৯টায় বাসায় এসে মেয়ের জন্মদিনের কেক কাটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হই। এ অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ্য করে গতকাল ঢাকা থেকে মেয়েটার নানা-নানি ও দুই মামা সপরিবারে বেড়াতে এসেছেন।
২৭ মে ২০০৭, রবিবার। সকাল সাড়ে ৮টায় সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের অফিসের উদ্দেশে রওনা করি। সেখানে পরপর কয়েকটি মাসিক সভায় অংশগ্রহণ করে বিকেল ৪টায় হবিগঞ্জে ফিরে আসি। বিকেলে সাড়ে ৪টায় ঢাকা থেকে আগত আমার আত্মীয়স্বজনেরা চলে যান।
হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নিউফিল্ড মাঠে হবিগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক মাসব্যাপী কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় ১৫০টি স্টল রয়েছে। এছাড়া বিনোদনের জন্য আছে সার্কাস, পুতুল নাচ ও মটরসাইকেল রেস। বিকেল সাড়ে ৫টায় সে মেলার উদ্বোধন করে বাসায় ফিরে আসি।
পরের দিন সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে ঘণ্টাদুয়েক কাজকর্ম করে ১১টায় জেলা আনসার ও ভিডিপি মহাসমাবেশে যোগদান করি। সেখান থেকে সাড়ে ১২টায় উমেদনগর টাইটেল মাদরাসায় গিয়ে জেলার কওমী মাদরাসাসমূহের শিক্ষকদের সম্মেলনে যোগদান করি। এ সম্মেলনে পুলিশ সুপার ও সেনাবাহিনীর সিও যোগদান করেন। সম্মেলন একসময় মতবিনিময় অনুষ্ঠানে রূপ নেয়। সে অনুষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা যাতে কোনোক্রমেই উগ্রবাদের জন্ম না দেয় সেদিকে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ধর্মীয় শিক্ষকগণকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়। মাদরাসা থেকে বিকেল আড়াইটায় নিজ অফিসে ফিরে আসি।
২৯ মে ২০০৭, মঙ্গলবার। সকাল ১০টায় স্টাফ অফিসারকে সঙ্গী করে লাখাই উপজেলায় যাই। সেখানে ইউএনও কর্তৃক বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে আয়োজিত দুর্নীতি বিরোধী মতবিনিময় সভায় যোগদান করি। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন ‘শুদ্ধি অভিযান ও ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স’ বার্তা অবহিত করি। সবাইকে সতর্ক হয়ে দিনাতিপাত করার জন্য নির্দেশনা দিই।
অতঃপর লাখাই থানায় গিয়ে পরিদর্শন করি। সেখান থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বামই ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যাই। সেখানে পরিদর্শন শেষে বিকেল ৩টায় নিজ অফিসে ফিরে আসি। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বিআরডিবি’র মাঠকর্মী বাছাই পরীক্ষার ভাইভা নেই।
আজ চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসায় ডিনারের দাওয়াত থাকায় রাত ৮টায় স্ত্রী-কন্যাসহ সেখানে যাই। সৌখিন ইউএনও নাভিদ শফিউল্লাহ বাসাটি বেশ পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছেন। দেখে বেশ ভালো লাগল। ডিনার শেষে ফিরার সময় সে একটি বনসাই বটগাছ সুসজ্জিত টবসহ আমাদের গাড়িতে তুলে দিয়ে বলল, ‘এটি ভাবির জন্য উপহার’। আমার গাছপ্রিয় মিসেস তাতে বেশ উৎফুল্ল হয়ে তাঁকে সাথে সাথে ‘থ্যাঙ্ক ইউ ভাই’ বলতে ভুল করল না। (চলবে…)