পাঠকের কলাম…

মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন

তিনি কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না। মাস শেষে তিনি কোনো বেতন পেতেন না। অথচ তাঁর ছিল প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী। ছিল জ্ঞান দেয়া-নেয়ার আয়োজন। নিজের বাড়িটাকেই তিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন একটি বিদ্যালয়। বলছিলাম হবিগঞ্জের সদ্য প্রয়াত জনপ্রিয় শিক্ষক জবরু মিয়ার কথা।
জবরু মিয়া হবিগঞ্জ শহরের শায়েস্তানগরের বাসায় সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত শিক্ষার্থীদের পড়াতেন। শুক্র ও শনিবারে খোলা থাকতো তার পাঠশালা। প্রতি শুক্রবারে সহশিক্ষা কার্যক্রমের মহড়া হতো। শিক্ষাদান ছিলো তার ব্রত। একজন প্রকৃত শিক্ষকের কাছে শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। কেনাবেচার সামগ্রী নয়। ছাত্রদের বুকের গভীরে জ্বালিয়ে রাখা আগুনে পুড়িয়ে তাদের সোনা বানান তিনি। জবরু স্যার এমনই একজন শিক্ষক ছিলেন। তার হাসিমুখ শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ^াসী করে তুলতো। পড়–য়াদের সুপ্ত প্রতিভা তিনি জাগিয়ে দিতেন, দিতেন স্বীকৃতি। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তিনি তাদের পুরস্কৃত করতেন। শিক্ষার্থীদের তিনি মানুষ করেছেন পড়িয়ে, বুঝিয়ে, শাসন করে। প্রীতিপূর্ণ আচরণের কারণে জবরু স্যার হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষার্থীদের বন্ধু, পরিচালক ও অভিভাবক।
তুলনামূলক দুর্বল শিক্ষার্থীদের তিনি অতিরিক্ত যতœ নিতেন। অমনোযোগীদের প্রতি দিতেন বিশেষ নজর। ঝড়েপড়া রোধে তিনি ছিলেন অনন্য। যেসব শিক্ষার্থীর পক্ষে পরীক্ষায় পাস করা ছিল কঠিন সেব শিক্ষার্থীকে পরম মমতায় তিনি পাসের স্বপ্ন দেখাতেন এবং তা বাস্তবায়ন করতেন। টাকা দিলেও তিনি পড়াতেন, টাকা না দিলেও তিনি পড়াতেন। কোমলে-কঠোরে, শাসনে-আদরে শিক্ষক জবরু মিয়া তাঁর ছাত্রদের গড়ে তোলেন আদর-স্নেহে। পড়–য়ার চোখে স্বপ্ন বুনে দেওয়াই ছিল তার আসল কাজ।
তিনি শুধু অন্যের সন্তানকে মানুষ করেননি। নিজের সন্তানদের যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন পরম আন্তরিকতায়। সাংসারিক টানাপোড়েন তাঁর স্বপ্নকে বাঁধাগ্রস্ত করতে পারেনি। তিন ছেলে দুই মেয়ে সবাই উচ্চ শিক্ষিত। বড় ছেলে প্রফেসর ড. জহিরুল হক শাকিল হবিগঞ্জের গর্ব। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য। বাকী ছেলে-মেয়ে ও মেয়ের জামাইরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
বিনয়ী, ন¤্র, ভদ্র ও কর্তব্যনিষ্ঠ জবরু মিয়া একজন সফল বাবা, একজন স্বার্থক শিক্ষক এবং একজন প্রতিশ্রুতিশীল সংগঠক ছিলেন। হবিগঞ্জ বিতর্ক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোঃ জবরু মিয়া হবিগঞ্জে বিতর্ক চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। চারপাশের কুৎসিত আঁধারের বিপরীতে তিনি ছিলেন নির্মোহ, নির্লোভ ও কর্মঠ। অবণত চিত্তে বলতে চাই ‘সমস্ত বকুল ফুল, যা জন্মেছে, জন্ম হতে আজ অবধি, শ্রদ্ধায় ভরিয়ে দিলাম তোমার সমাধি।’
লেখক ঃ অধ্যক্ষ, জহুর চান বিবি মহিলা কলেজ
শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ।