অতিথি সাংবাদিকের কলাম
-এম এ মজিদ-

বেশ কিছুদিন যাবত আমি চিন্তা করতে লাগলাম আধুনিকতা বা ডিজিটাল সমাজ কাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। সেই আঘাতের ধরনটা কি কিংবা তা সহ্য করার মতো কি না। আমার দৃষ্টিতে আধুনিকতা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে বাবা মাকে এবং তা সহ্য ক্ষমতার বাহিরে।
১। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী এক বাবা এক মাসের ছুটিতে দেশে এসেছেন মেয়েকে বিয়ে দিতে। ইউরোপ প্রবাসী এক ছেলের সাথে বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক। ইতিমধ্যে জানতে পারলেন মেয়েটি একটি ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। অনেক আজেবাজে ভিডিও আছে। থমকে গেলেন। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ৫ তলা বাসার মালিক বাবা কিছুতেই বেকার ছেলের সাথে মেয়ের প্রেম মেনে নিতে পারছেন না। মেয়ে বাবাকে বুঝাতে লাগল, এসব কিছু না, তোমরা তোমাদের মতো করে আমার বিয়ে ঠিক করো। বিয়ে প্রায় ঠিক মেয়ের বাবা জানতে পারলেন আরেক অর্ধ শিক্ষিত ছেলের সাথে মেয়ের একইভাবে প্রেমের সম্পর্ক, আজেবাজে ছবিও আছে। হতাশাগ্রস্থ বাবাকে মেয়ে আবারও শান্তনা দিয়ে বলল, বাবা এসব কিছুই না, আমি কিছুটা ভুল করেছি, তাও বেশি না। তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করো। ইউরোপ প্রবাসী ছেলে এসব জেনে ছিটকে পড়ল, বাবা অন্য এক ছেলের সাথে বিয়ের কথাবার্তা পাকা করলেন। দুদিন পরে বিয়ে। ঈদের দিন মেয়ে পালিয়ে গেল, ওই অর্ধ শিক্ষিত ছেলের সাথে। এর একদিন পর মেয়ের ইচ্ছায় কমিউনিটি সেন্টারে ঘটা করে বিয়ে আয়োজন করা হল। তাতে ছেলে পক্ষের কয়েকশ অতিথি। মেয়ের বিয়েতে মেয়ের বাবা, মা আত্মীয় স্বজনের কেউ দাওয়াতই পেল না।
২। কোর্ট কাচারীতে সরকারী চাকুরী করেন এমন একজন লোক আমার ঘনিষ্ট ছিলেন। তিনি প্রায়ই আমাকে বলতেন- আমার সন্তানকে তোমার মতো ওকিল বানাব। যদিও এডভোকেট হিসাবে কিংবা সাংবাদিক হিসাবে আমি কারো আদর্শ নই। অনেক কষ্ট করে তিনি সন্তানকে এডভোকেট বানালেন, কিন্তু তিনি এডভোকেটের গর্বিত পিতা হতে পারলেন না। সন্তান অন্য বাবার সন্তানের সাথে চলে গেছে। অনেকদিন পরে খুব আয়োজন করে কমিউনিটি সেন্টারে বিয়েও হয়েছে। বিয়ের কার্ডে মেয়ের বাবার নাম আছে কিন্তু মেয়ের বাবা তা জানেনই না।
৩। অসুস্থ পিতাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর সেই পিতাকে বাসা পর্যন্ত পৌছে দেয়ার মতো সময় ছিল না মেয়েটির। রাস্তায় বাবাকে একাকি ফেলেই মেয়ে পালিয়ে গেছে অন্য ছেলের সাথে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় পিতা এদিক সেদিক থাকিয়ে দেখেন মেয়ে নাই। অসুস্থ শরির নিয়ে তিনি বাসায় আসবেন না কি মেয়ে খুঁজবেন। দীর্ঘ সময় পর মেয়ের বাবা অন্যের হাতে ভর করে রিক্সায় উঠে বাসায় ফিরলেন। সবাই জিজ্ঞাসা করল মেয়ে কই, মেয়ের বাবার মুখে কোনো জবাব নাই। দিন গেল মধ্য রাতে আবিষ্কার হল, মেয়ে তার প্রেমিকের সাথে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ক্রস করছে।
৪। ঈদের পরের দিন একজন পরিচিত লোক ফোন করে একটি মামলা লেখার জন্য চেম্বারে আসার অনুরোধ করলেন। আমি চেম্বারে এসে জানলাম- একটি মেয়ে তার প্রেমিকের সাথে ঈদের দিন বিকালে চলে গেছে। ছেলের বাবা মা মেয়েটিকে মেনে নিতে রাজি হয়নি। এক পর্যায়ে নির্যাতন করা হয়। সন্ধ্যার দিকে মেয়েটিকে একটি টমটম গাড়িতে করে অর্ধমৃত অবস্থায় বাবার বাড়ির সামনে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। রাতে মেয়েটি মারা গেছে। বাবা এসেছেন মামলা লিখাতে।
আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে এসব মেয়ের বাবারা কেমন আছেন? কিভাবে কাটছে তাদের জীবন? বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশী সহকর্মীদের সামনে কিভাবে মুখ দেখাচ্ছেন তারা? অনেক বাবাকে বলতে শুনেছি, আত্মহত্যা মহাপাপ না হলে তারা আত্মহত্যাই করতেন।
নোটঃ আমার বড় মেয়েটি জন্মের পর একাধারে ১১ মাস ভোর ৫/৬টার আগে একদিনও ঘুমায়নি। ছোট মেয়েটি জন্মের পর বিগত প্রায় ৩ বছর যাব রাত ৪/৫টার আগে ঘুমায়নি। এমনকি গতকালও নয়। আমি হয়তো বিভিন্ন অজুহাতে পরের দিন অফিসে আসার কথা বলে- অন্য রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি কিন্তু মা তো মেয়েকে রেখে অন্য রুমে গিয়ে ঘুমানোর কোনো অজুহাত খুঁজে পায়নি। এমনও মা আছেন, সারা রাত সন্তানের জন্য সজাগ থেকে পরের দিন সকাল ৯টার আগেই অফিসে যান। আমার সন্তানদের মাও এমনটি কিছুদিন করেছেন। উপরোক্ত ৪টি ঘটনাসহ অসংখ্য ঘটনায় মেয়েদের মা-রা কেমন আছেন তা জানার দুঃসাহস আমার নেই।
এম এ মজিদ, আইনজীবী ও সংবাদকর্মী
হবিগঞ্জ ১৪ এপ্রিল ২০২৪
০১৭১১-৭৮২২৩২