রাজনীতি চলে রাজনীতির ধারায়, আর দেশের মানুষ ব্যস্ত রুটি-রোজগারে
আতাউর রহমান কানন
৫ ডিসেম্বর ২০০৬, মঙ্গলবার। সকাল-সন্ধ্যা অফিস করে যাচ্ছি। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা প্রশাসনের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। দেশের এই অস্থির অবস্থা কত দিন চলবে তা আর অনুমান করেও বলা যাচ্ছে না। আজ সংবাদে দেখলাম, এবার সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিগণ কোর্ট পরিচালনার কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছেন। বিগত ৩০ নভেম্বরে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনজীবীগণ ক্ষমা প্রার্থনা না করা পর্যন্ত এই কর্মবিরতি চালাবেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এমন অচল অবস্থা দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও বাড়াবে বৈ কমাবে না, তা সহজ অনুমেয়।
৬ ডিসেম্বর ২০০৬, বুধবার। আমি সকালে যথারীতি অফিসে কাজ করছিলাম। একসময় জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আমার অফিসকক্ষে একটি জরুরি নথি নিয়ে আসেন। আমি নথিটিতে স্বাক্ষর করে দিলে তিনি নথি বাঁধতে বাঁধতে বললেন, স্যার, আজকালের মধ্যে নির্বাচনি পুনঃতফসিল ঘোষণা হতে পারে। নির্বাচন কমিশনে আলোচনা হচ্ছে। আমি বললাম, যা হয় হোক, আমাদের কাজ চালিয়ে যান।
অফিস শেষে বাসায় এসে সন্ধ্যার পর টেনিস কোর্টে গিয়ে ঘণ্টাখানেক খেলে সাড়ে ৭টায় বাসায় ফিরে ফ্রেশ হলাম। রাতের সংবাদে দেখলাম, সাংবাদিকদের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে নির্বাচন কমিশনের সচিব জানান যে, নির্বাচনি কার্যক্রমের পুনঃতফসিলিকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সংবাদের রেশ ধরে বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া তাঁর প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের জানান যে, সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে; কোনোক্রমেই এর ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না।
সংবাদ দেখে আমার মনে হলো, স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ওপর দ্বিমুখী চাপ ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। এমন চিড়েচ্যাপ্টা চাপের কারণে এদেশে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কি আদৌ বাস্তবে স্বাধীন থাকতে পারে! তবে রাজনীতিবিদদের মুখরোচক বাণী- ‘শেষ বলে নাকি রাজনীতিতে কিছুই নেই।’ দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।
পরদিন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের পুনঃতফসিল ঘোষণা করে। এতে ভোটগ্রহণের দিন একদিন পিছিয়ে ২১ জানুয়ারির স্থলে ২২ জানুয়ারি করা হয়।
৮ ডিসেম্বর ২০০৬, শুক্রবার। সময় বসে থাকে না। রাজনীতি চলে রাজনীতির ধারায়, আর দেশের মানুষ ব্যস্ত থাকে তাদের রুটি-রোজগারে। পুনঃতফসিল ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ১৪দলীয় জোট নির্বাচনে যাওয়ার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে তাদের সিদ্ধান্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাস্তবায়নের আল্টিমেটাম দেয়। এতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের ধোঁয়াশা ঘণীভূত হতে থাকে।
৯ ডিসেম্বর ২০০৬, শনিবার। সকালে অফিসে গিয়ে নির্বাচনি কাজকর্ম জোরদার করলাম। নির্বাচন অগ্রাধিকার দিয়ে ছুটির দিনেও অফিস খোলা রেখেছি। ইউএনওগণ সহকারী রিটার্নিং অফিসার। তাঁদের অফিসও খোলা। সকাল থেকেই ইউএনওদের ফোন করে করে পুনঃতফসিল অনুযায়ী তাঁদের কার্যক্রমের অগ্রগতি জেনে নিই।
সন্ধ্যার সংবাদে দেখলাম, মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা সারাদেশে আর্মি নিয়োগ আদেশ জারির নির্দেশ প্রদান করেছেন। তবে এই নিয়োগে নির্দেশ জারিতে উপদেষ্টাদের নাকি ঘোর আপত্তি ছিল।
পরের দিন রাতে রাষ্ট্রপতি রেডিয়ো-টিভিতে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে সারাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়নের যুক্তি প্রদান করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সেনাবাহিনী মোতায়েনের আদেশ বিএনপি পূর্ণ সমর্থন জানায়। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ এর বিরোধিতা করে জানায় যে, দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েনের মতো কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
১১ ডিসেম্বর ২০০৬, সোমবার। সকালে অফিসে গিয়ে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সেনাবাহিনীর অগ্রিম টিম আমার সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁদের আবাসন বিষয়ে আলাপ করেন এবং সার্কিট হাউজে থাকার জন্য অগ্রাধিকার দেন। এ ছাড়া কিছু সুবিধাদি সরবরাহের একটি তালিকা দেন। আমি সম্ভাব্য সহায়তা প্রদান করা হবে জানালে, তাঁরা চলে যান। আমি এবার বুঝে নিলাম যে, যেমন করেই হোক ঘোষিত তারিখেই সরকার নির্বাচন করবে।
সন্ধ্যার সংবাদ দেখে বিস্মিত হলাম! রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নানা ব্যর্থতা ও কাজের সুস্থ পরিবেশ না পাওয়ার অজুহাতে ৪ জন উপদেষ্টা- ড. আলি আকবর খান, সিএম শফি সামি, লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী (অব.) ও সুলতানা কামাল পদত্যাগ করেছেন। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবস্থা যে সঙ্কটের মুখে পতিত তা আর আমার বুঝতে বাকি রইল না। আমার প্রশাসনিক কাজের পালে একবার বৈশাখী ঝড়ো হাওয়া, আরেকবার শীতের হিমেল হাওয়া লাগছে।
১২ ডিসেম্বর ২০০৬, মঙ্গলবার। সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে আমার অফিসের এডিএম-এডিসিদের নিয়ে বসি। তারাও দেশের এমন অবস্থায় বেশ উদ্বিগ্ন। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দেশের পরিস্থিতি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে থাকার উপায়ও নেই। তবে দেশের কাজ তো আর থেমে থাকতে পারে না।
আজ রাতের সংবাদে দেখলাম যে, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা দুদিনের মধ্যেই তাঁর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য নতুন করে ৪ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে তাঁদের শপথ পড়ান। এতে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার বাসিন্দা ‘আশা’ এনজিও’র প্রতিষ্ঠাতা মো. শফিকুল হক চৌধুরী অন্যতম।
পরের দিন সকালের দিকে লাখাই উপজেলার বাসিন্দা মোখলেস চৌধুরী, যিনি কিছুদিন পূর্বে মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন, আমাকে টেলিফোনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নবনিযুক্ত উপদেষ্টা মো. শফিকুল হক চৌধুরী সম্পর্কে ব্রিফ করেন। উপদেষ্টা সাহেবের এক ভাই হবিগঞ্জ শহরের হাসপাতাল সড়কে সপরিবারে বসবাস করেন বলে জানান এবং তাঁদের খোঁজখবর রাখতে বলেন। এ ছাড়া নবনিযুক্ত উপদেষ্টার সঙ্গে টেলিফোনে সৌজন্য আলাপ করতেও পরামর্শ দেন।
এ দিন মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে মোতায়েনকৃত সেনাবাহিনীকে স্ট্যান্ডবাই থাকার নির্দেশ জারি করেন। এতদ্ব্যতীত দুইজন বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনারকে ছুটিতে পাঠাতে সিদ্ধান্ত নেন।
১৪ ডিসেম্বর ২০০৬, বৃহস্পতিবার। আমি আপাতত মাঠ পর্যায়ের দর্শন-পরিদর্শন স্তিমিত করে নির্বাচন এবং এ সংক্রান্ত আদেশ-নির্দেশ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকছি।
নির্বাচনি খেলা মাঠ পর্যায়ে এখনও চায়ের দোকানেই ঝড় তুলে যাচ্ছে। প্রার্থীগণ তেমন কোনো তৎপরতা চালান নি। তবে জাতীয় রাজনীতির কর্দমাক্ত মাঠে নির্বাচনি খেলা এবার তেমন একটা সহজ হবে না। আজ রাতের বেলা সংবাদে দেখলাম, মাননীয় হাইকোর্ট জাপান থেকে রেসকিউ বোট ক্রয়ের দুর্নীতির মামলায় সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদকে ইতঃপূর্বে প্রদত্ত দুই বছরের স্থগিত সাজা কার্যকর করার আদেশ দিয়েছেন। আর এ আদেশের পরই এইচএম এরশাদ তাঁর ভাই জিএম কাদেরকে দল থেকে যে বহিষ্কার করেছিলেন, তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। (চলবে…)