টিলা-বনবনানী ঘেরা ছায়া সুনিবিড় হবিগঞ্জ

১৯৭৭ সালে কেজি স্কুলের আদলে সরকারি ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘দি রোজেস’ শিশু-কিশোর বিদ্যালয়। এটি একটি আদর্শ বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরে এর নামকরণ হয় ‘দি রোজেস কালেক্টরেট স্কুল’

আতাউর রহমান কানন

১ নভেম্বর ২০০৬, বুধবার। আমি সকাল ৯টায় অফিসে যাই। অফিসের কাজকর্মে মনোনিবেশ করি। এখন দেশের পরিস্থিতি হেমন্তকালের গুমোট সাগরের শান্ত ঢেউয়ের মতো। মনে হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট বিএনপি প্রভাবিত নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। এদিকসেদিক কিছু হলে গুমোট সাগরে নিম্নচাপ ঘণীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। আজ রাতে উপদেষ্টাদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করা হয়।
পরের দিন সকাল ৯টায় সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের উদ্দেশে বের হই। সেখানে পৌঁছে ১১টায় জন্মনিবন্ধন সংক্রান্ত বিভাগীয় টাস্কফোর্সের সভায় অংশগ্রহণ করি। সভা শেষে বিভাগীয় কমিশনার ডিসিদের নিয়ে একান্তে বসে দেশের চলমান রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেন। আমাদের ধৈর্য্য ধারণ করে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি সামলানোর জন্যও বলেন। সেখান থেকে বিকেল তিনটায় হবিগঞ্জে নিজ অফিসে ফিরে আসি।
৪ নভেম্বর ২০০৬, শনিবার। সকাল ১০টায় জাতীয় সমবায় দিবস উদ্যাপনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় ও সমবায় পতাকা উত্তোলন করে একটি সুসজ্জিত র‌্যালি নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করি। এরপর সকাল ১১টায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, হবিগঞ্জ জেলা শাখার বার্ষিক সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। বেলা দেড়টায় বাসায় ফিরে সাপ্তাহিক ছুটির এ দিনটির বাকি সময় বাসাতেই কাটাই। এ দিন রাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একজন উপদেষ্টা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করে জানতে চান যে, উপদেষ্টা পরিষদ অনুরোধ জানালে তিনি পদত্যাগ করবেন কি না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাঁকে ‘না সূচক’ জবাব দেন।
৬ নভেম্বর ২০০৬, সোমবার। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বর্তমানে আকাশভরা মেঘের মতো থমথমে। ১৪ দলীয় জোট নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের জন্য আগে থেকেই দাবি করে আসছিল। তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেই দাবি পূরণ করে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করলেই তারা নির্বাচনে যাবে; অন্যথায় আন্দোলন চলবে। আমি সারাদিন অফিসেই ছিলাম। সন্ধে ৬টায় বিভাগীয় কমিশনার আবদুল হাকিম মন্ডল হবিগঞ্জে আসেন। তিনি ঢাকায় বদলি হয়েছেন। আজ হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তিনি ডিনার শেষে রাত ৯টায় চলে যান।
৭ নভেম্বর ২০০৬, মঙ্গলবার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে। এই ছুটির দিনসহ দুদিনের ছুটি ঢাকায় কাটানোর জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে অনুমতি নিই। আজ সকালে হবিগঞ্জ ত্যাগ করে সকাল ১১টায় ঢাকার বাসায় পৌঁছি। দুপুরে এক খালাতো শ্যালক রাসেলের বউভাতে যোগদান করি।
৯ নভেম্বর ২০০৬, বৃহস্পতিবার। সকাল সাড়ে ৬টায় ঢাকা থেকে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা করি। আজ সাতসকালে ঢাকা থেকে বের হওয়ার পর আবহাওয়াটা বেশ মোলায়েম ও শান্ত মনে হতে লাগল। রাস্তায় এখনও তেমন একটা যানবাহন নামেনি। আমার জীপগাড়িটি ফাঁকা রাস্তায় শাই শাই ছুটে চলেছে। হেমন্তের মাঝামাঝি গ্রামীণ জনপদে গাছগাছালির পাতায় পাতায় শিশিরের ছোঁয়া লেগেছে। পাখপাখালিরা খাবারের খোঁজে মাঠেপ্রান্তরে ওড়াউড়ি করছে। রাস্তার পাশের জলাভূমিতে জেলেরা নানা কৌশলে মাছ ধরে বেড়াচ্ছে। আমি উদাসীমনে গ্রামবাংলার চিরায়িত রূপ দেখে বিমোহিত! কল্পনায় আপনমনে নানা রঙের ছবি এঁকে যাচ্ছি। আমার মনে পড়ল কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বাংলার মুখ’ কবিতার কয়েকটি চরণ- ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ পরক্ষণেই মনে এলো- এমন রূপসী বাংলার রাজনীতির উত্তাপ এত রক্তঝরা কেন? গদি দখলের কামড়াকামড়ি-লাঠালাঠি লেগেই আছে- ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী।’
সময় বড় দ্রুত চলে যায়। আমি একসময় টিলা-বনবনানী ঘেরা ছায়া সুনিবিড় হবিগঞ্জের রাজত্বে প্রবেশ করি।
সকাল সাড়ে ৯টায় বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হয়ে অফিসে যাই। আমার দায়িত্বে থাকা এডিসি জেনারেলের কাছ থেকে বিগত দুদিনের জেলার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত। একটানা অফিস করে বিকেল সাড়ে ৫টায় বাসভবনে ফিরে আসি।
পরের দিন বিভাগীয় কমিশনার আবদুল হাকিম মন্ডল সিলেট থেকে বিদায় নিয়ে হবিগঞ্জ হয়ে ঢাকা রওনা করেন। তাঁকে সিলেট বিভাগের গেট নামে পরিচিত মাধবপুর উপজেলায় গিয়ে বিদায় জানাই।
১১ নভেম্বর ২০০৬, শনিবার। সকাল ১১টায় ‘দি রোজেস’ শিশু-কিশোর বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভায় যোগদান করি। এই বিদ্যালয়টি ১৯৭৭ সালে কেজি স্কুলের আদলে সরকারি ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি একটি আদর্শ বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরে এর নামকরণ হয় ‘দি রোজেস কালেক্টরেট স্কুল’। স্কুলটি হবিগঞ্জ শহরের নিউফিল্ড এলাকায় খোলামেলা এক মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। জেলা প্রশাসকগণ এ বিদ্যালয়ের পদাধিকার বলে সভাপতি। সভাপতি হিসেবে এবারই এ প্রতিষ্ঠানে আমার প্রথম আগমন। ফুলের তোড়া দিয়ে গোলাপী ড্রেসপরা শিশু শিক্ষার্থীরা আমাকে মনোমুগ্ধকর শুভেচ্ছা জানায়। ম্যানেজিং কমিটিতে শহরের সম্মানিত কয়েকজন ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন। অনেকের সাথেই আমি পূর্বপরিচিত। নির্ধারিত সময়ে সভা শুরু হয়। সভা ঘণ্টাখানেক চলে। সভা শেষে সাড়ে ১২টায় বাসভবনে ফিরে আসি।
আজ বিকেলে সরকারি আদেশে ১৪ জন ডিসি প্রত্যাহার এবং ২৩ জনকে জেলা থেকে জেলায় বদলি করা হয়। আমি অক্ষত থাকি। তবে যে কোনোদিন প্রত্যাহার বা বদলির আদেশ পেতে পারি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে সব সময়েই মাঠ প্রশাসন ঢেলে সাজানোর জন্য সাধারণত ডিসি-এসপি ও ইউএনও-ওসিদের ক্ষেত্রে এমন প্রত্যাহার-বদলি হয়ে থাকে।
১৪-দলীয় জোটের পেশকৃত ১১ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় আজ থেকে আবার দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ কর্মসূচি আরম্ভ হয়েছে। জেলা প্রশাসনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার যথাযথ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
১২ নভেম্বর ২০০৬, রবিবার। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের দ্বিতীয় পর্যায়ের লাগাতার অবরোধ চলছে। নির্বাচন কমিশন সংস্কার না হলে এই অবরোধ চলতে থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সরকারের উপদেষ্টাগণ নির্বাচন নিয়ে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন আর করতে সমর্থ হন না। ১৪ দলীয় জোট তাদের লাগাতার অবরোধ কর্মসূচিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগের দাবিতে তাঁর বাসভবন অবরোধ করে রেখেছে। দিন যায় কথা বাড়ে, আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে; কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার অনড়। তাঁর বাসার বাজার সদাই পর্যন্ত সংকটে পড়ে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন, এমন আভাস-ইঙ্গিত এখনও নেই। নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের কয়েকজন বিষয়টি নিয়ে দৌড়ঝাঁপ পারছেন। বিশেষ করে জনাব মাহবুবুল আলম তো রীতিমতো গলধগর্ম।
আমি সকাল থেকেই অফিসে ছিলাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়ে রেখেছি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কাজ ৯০ দিনের ভেতর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। সে কাজ এখনও শুরু করতে পারেনি। আন্দোলনের কারণে এ সরকারও অস্থির আছে।
এদিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজ রিপোর্টারদের অবহিত করেন, ২৫ শে নভেম্বরের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন। বিকেলে উপদেষ্টাদের অন্ধকারে রেখে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা সারা দেশে সেনাবাহিনী নিয়োগের আদেশ জারি করেন; কিন্ত সেদিন রাতেই আবার তা রহিত করেন।
(চলবে…)