স্টাফ রিপোর্টার ॥ বানিয়াচঙ্গের আড়িয়ামুগুর পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়োগসহ অনিয়মের প্রতিবাদ করায় জগদীশ চন্দ্র দাস নামে এক আইনজীবীকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষকসহ আড়িয়ামুগুর গ্রামবাসী এক শালিসের মাধ্যমে তাকে সমাজচ্যুত করেন। আত্মসম্মানের ভয়ে গত ৩ মাস ধরে নিজ গ্রাম আড়িয়ামুগুরে যাচ্ছেন না জগদীশ চন্দ্র দাস। শুধু তাই নং, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত আবেদন করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না তিনি। এ অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন জগদীশ চন্দ্র দাস।
সূত্র জানায়, আড়িয়ামুগুর পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যে কয়েকজন উদ্যোক্তা রয়েছেন এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলেন অ্যাডভোকেট জগদীশ চন্দ্র দাস। তিনি বিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার পর থেকে তিনি এ পদ থেকে সড়ে যান। পদাধিকার বলে প্রধান শিক্ষক সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে ভালো শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্রদের খেলার মাঠের ব্যবস্থা, পাঠদানের অনুমতি, স্বীকৃতি গ্রহণ ও এমপিওভূক্তি করণের জন্য সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগযোগসহ সর্বক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। শুরুর দিকে পরিচালনা কমিটির সঠিক দায়িত্ব পালন ও দিক নির্দেশনায় এবং শিক্ষকদের যথাযথ পাঠদানের ফলে বিদ্যালয়টি ভালো ফলাফল অর্জন করে আসছিল। এক পর্যায়ে এলাকার লোকজন গোষ্ঠীগত আধিপত্য বিস্তার করে স্বল্প শিক্ষিত লোক ম্যানেজিং কমিটিতে সভাপতিসহ অন্যান্য পদে অন্তর্ভুক্ত করে বিদ্যালয়ের ৪টি পদে লোক নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এ প্রেক্ষিতে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ এনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সিলেট এর চেয়ারম্যান, বিদ্যালয় পরিদর্শকের বরাবর লিখিত আবেদন করেন আড়িয়ামুগুর গ্রামের এক ব্যক্তি। এতে গ্রামের অর্ধশতাধিক লোক সাক্ষর করেন। ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ৮ম শ্রেণি পাস করা কম বয়সী ব্যক্তি এলাকার গোষ্ঠীগত প্রভাব বিস্তার করে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। একই শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যক্তিকে বিদ্যোৎসাহী হিসেবে মনোনীত করা হয়। পরবর্তীতে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ কমিটির কয়েকজন সদস্য ও প্রধান শিক্ষকের যোগ সাজসে একজন সহকারি প্রধান শিক্ষক, একজন কম্পিউটার অপারেটর, একজন অফিস সহায়ক ও একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করেন। আবেদনে ওই নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করার দাবি জানানো হয়। এ বিষয়ে স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়। ওই সংবাদের পাল্টা প্রতিবাদ দেন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বিকাশ দাসসহ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এই প্রতিবাদকে মিথ্যা দাবি করে আরেকটি প্রতিবাদ দেন অ্যাডভোকেট জগদীশ চন্দ্র দাস।
জগদীশ চন্দ্র দাসের অভিযোগ- তিনি প্রতিবাদ দেয়ায় বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি ও প্রধান শিক্ষক বিনয় ভূষণ দাস গ্রামবাসীকে ভুল বুঝিয়ে জগদীশ চন্দ দাসের প্রতি ক্ষিপ্ত করে তুলেন। গ্রামের কিছু লোক জগদীশ দাসকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। এতে জগদীশ দাস পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রতিবাদের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেন। গত ১৪ অক্টোবর গ্রামের এক শালিস বৈঠকে জগদীশ দাসকে সমাজচ্যুত করা হয়। শালিস বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সুকুমার দাস। শুধু তাই নয়, শালিসে গ্রামের মৎস্যজীবী সমিতির লভ্যাংশ তাকে না প্রদান করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন জগদীশ চন্দ্র দাস। এ খবরে তার উচ্চ শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা মর্মাহত হন। পরবর্তীতে জগদীশ চন্দ্র দাস নিজেকে সমাজচ্যুত অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য ১৯ অক্টোবর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বানিয়াচং সার্কেল) বরাবর দরখান্ত দেন। এতেও বিষয়টির সুরা হয়নি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নির্দেশনা অমান্য করে আরেক শালিসে রায় বহাল রাখেন হরিপদ মাস্টার। হরিপদ মাস্টার শালিসে অ্যাডভোকেট জগদীশ চন্দ্র দাসকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় দিশেহারা হয়ে নিজের সম্মান রক্ষায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর বানিয়াচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন অ্যাডভোকেট জগদীশ চন্দ্র দাস। কিন্তু তার পরও এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
সরেজমিনে আড়িয়ামুগুর গ্রামে গিয়ে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে বিদ্যালয়টি ম্যানেজিং কমিটির কয়েকজন সদস্য ও প্রধান শিক্ষক পরিচালনা করছেন। গ্রামের মেম্বার মিষ্ট লাল দাশ জানান, বিদ্যালয়ের ৪টি পদে নিয়োগ দেয়া হবে। এর মধ্যে একটি পদে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির ভাইও প্রার্থী। যেখানে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য’র ভাই প্রার্থী থাকবেন সেখানে ওই সদস্য তার ভাইয়ের পক্ষে অবস্থান নেবেন এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়সহ স্কুলের বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদ করায় অ্যাডভোকেট জগদীশ চন্দ্র দাসকে শালিসে সমাজচ্যুত করা হয়েছে। ওই শালিসের বোর্ডে তিনি ছিলেন উল্লেখ করে বলেন- আমি সমাজচ্যুত না করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু বোর্ডের অন্যান্য সদস্যরা আমার কথা শুনেননি। তিনি স্কুলের নিয়োগ পরীক্ষা স্কুল ছাড়া অন্য কোথায়ও নেয়ার দাবি জানান।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে শালিস বৈঠকের সভাপতি সুকুমার দাস জানান, অ্যাডভোকেট জগদীশ চন্দ্র দাস স্কুলসহ গ্রামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। এ জন্য তাকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে। তবে এ বিষয়টি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সমাধান করে দিয়েছেন। এখন আর তিনি সমাজচ্যুত নন।
অ্যাডভোকেট জগদীশ চন্দ্র দাস বলেন, আমি পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে শহরে বসবাস করছি। পৈত্রিক সম্পত্তি দেখাশোনাসহ গ্রামে প্রয়োজনীয় কাজে যেতে হয়। গ্রামের স্কুলের নিয়োগে অনিয়মের প্রতিবাদ করায় বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ প্রধান শিক্ষক গ্রামবাসীকে আমার বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে আমাকে সমাজচ্যুত করেছেন এবং আমাকে গ্রামে না যাওয়ারও হুমকি দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় আমি আমার পরিবার নিয়ে গ্রামে যেতে পারছি না। আমি আমার পিতার বসতভিটায় যেতে চাই। এ জন্য প্রয়োজনীয় ববস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল্লাহ জানান, বিদ্যালয়ের অনিয়মের প্রতিবাদ করায় একজন ব্যক্তিকে সমাজচ্যুত করা সম্পূর্ণ বেআইনি। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে এবং যারা নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম করবে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বানিয়াচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহবুবুর রহমান জানান, এ ব্যাপারে আমি একটি অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।