নবীগঞ্জ উপজেলার অধিবাসীরা সবচেয়ে সচ্ছল এবং মামলা-মোকদ্দমাপ্রিয় ॥ সচ্ছল প্রবাসীগণ খুবই প্রশাসনপ্রিয়
আতাউর রহমান কানন
আমার আজ নবীগঞ্জে একইরূপ মতবিনিময় সভা থাকায় বেলা একটায় বানিয়াচং থেকে বিদায় নিয়ে নবীগঞ্জের উদ্দেশে রওনা করলাম। নবীগঞ্জ উপজেলায় পৌঁছে যথাসময়ে সভায় যোগদান করি। এখানে সভাকক্ষ প্রায় কানায় কানায় ভর্তি। আমন্ত্রিত অফিসার, ইউপি চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে তেমন কেউ অনুপস্থিত নেই বললেই চলে। ইউএনও সাহেব জানালেন, এখানের লোকজন সাধারণত প্রশাসনের দাওয়াত মিস করেন না। আর আমি চেনাজানা লোক ডিসি হয়ে আসায় নাকি তাঁদের মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছে।
তখন আমার স্মরণে এলো- পূর্বে আমি হবিগঞ্জ চাকরিকালে উপজেলা কোর্ট জেলা সদরে উঠে আসলে, আমি হবিগঞ্জ সদর কোর্টের দায়িত্বে থাকাকালে প্রায় দুবছর এই নবীগঞ্জের কোর্টও পরিচালনা করেছি। হবিগঞ্জ জেলার মধ্যে এই নবীগঞ্জ উপজেলার অধিবাসীরা সবচেয়ে সচ্ছল এবং সেই সাথে মামলা-মোকদ্দমাপ্রিয়। আর মামলার মক্কেলরা সচ্ছল মানে তো এ এলাকার বিজ্ঞ আইনজীবীরাও ভাগ্যবান! এছাড়া নবীগঞ্জের সচ্ছল প্রবাসীগণ খুবই প্রশাসনপ্রিয়। তাঁরা দেশে আসলে ডিসি-এসপি, ইউএনও-ওসি প্রমুখের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ না করে ফিরে যাবেন না। প্রবাসীদের অনেকেই এ এলাকার গ্রামেগঞ্জে বড় বড় গেটওয়ালা বিশাল বিশাল বাড়ি করে রেখেছেন। সে বাড়িতে কেয়ারটেকার বা দূরসম্পর্কীয় কেউ পাহারাদারের মতো কাঁথা-বালিশ নিয়ে সংসার পেতে একপাশে পড়ে থাকেন। এসব বাড়ি দেখলে মনে হবে এরা টাকাপয়সা ফেলার কোনো জায়গা না পেয়ে এ কাজ করেছেন। আর বংশপরিচয় ও মর্যাদা রক্ষায় এরা বেশ টনটনে সজাগ।
ইউএনও জহুরুল ইসলাম রোহেল স্বাগত বক্তব্য দিয়ে এ এলাকার পটভূমিতে ‘একনজরে নবীগঞ্জ’ এর তথ্যাদি উপস্থাপন করেন। আমার জন্য তৈরি করা ফাইলেও সে তথ্যাদি রয়েছে। আমি তাঁর বক্তব্য শোনার ফাঁকে ফাঁকে ওই তথ্যাদিতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ জন অধ্যুষিত এই উপজেলার আয়তন ৪৩৯.৬০ বর্গ কিলোমিটার। ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে উপজেলাটি গঠিত। এদের প্রধান পেশা কৃষি। ধান, মাছ ও কলা প্রধান ফসল। ইমাম ও বাওয়ানী নামক দুটি চা-বাগান এ উপজেলায় রয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ গ্যাসফিল্ড ‘বিবিয়ানা’ উপজেলার দীঘলবাগ ও ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নে অবস্থিত।
নবীগঞ্জের নামকরণের ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত জনশ্রুতি হলো- হযরত শাহ নবী বক্স (র.) নামে জনৈক কামিল দরবেশ ইসলামের মহান বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে আগমন করেন এবং প্রবাহিত শাখা-বরাক নদীর তীরে আস্তানা গাড়েন। তাঁর স্থাপিত আস্তানাকে কেন্দ্র করে লোকসমাগম বাড়তে থাকার ফলে এখানে একটি গঞ্জ বা বাজারের গোড়াপত্তন শুরু হয়। পরবর্তীতে তাঁর নামের সম্মানার্থে এ গঞ্জ বা বাজারের নামকরণ হয় নবীগঞ্জ (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট)। নবীগঞ্জ নামকরণের ক্ষেত্রে অন্য একটি ভিন্নমত প্রচলিত আছে যে, ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ নবীগঞ্জ নামকরণ করা হয়েছিল (হবিগঞ্জ পরিক্রমা গ্রন্থ)।
হবিগঞ্জের অন্যান্য উপজেলার ন্যায় এখানেও বেশ কিছু মাজার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- শাহ মুশকিল আছান (র.)এর মাজার, শাহ তাজউদ্দিন কোরেশী (র.)এর মাজার; শাহ সদরউদ্দিন কোরেশী (র.)এর মাজার; শাহ ইউনুস উদ্দিন (র.)এর মাজার, শাহ কুতুবউদ্দিন (র.)এর মাজার, সৈয়দ নূর শাহ (র.)এর মাজার ও টঙ্গীটিলার মাজার। এঁদের অধিকাংশই নাকি হযরত শাহজালাল (র.) এর সফরসঙ্গী-শিষ্য ছিলেন।
আজ সৌজন্য মতবিনিময়ে অনেকের বক্তব্যই শুনলাম। তাঁরা এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কথাই বললেন। পৌর মেয়র তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীসহ প্রায় সব ইউপি চেয়ারম্যানই বক্তব্য রাখেন। তাঁরা অনেকেই এলাকায় গ্যাস সরবরাহের দাবিও উত্থাপন করে জানান যে, তাঁদের এলাকার বিবিয়ানার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যাবে অথচ তাঁরা পাবেন না, এটা মানা যায় না। আমি আমার সৌজন্য মতবিনিময় সভাটি দাবি-দাওয়ার সভায় পরিণত করতে চাইনি। তাই আমার বক্তব্যের এক পর্যায়ে তাঁদের দাবিসমূহ লিখিতভাবে আমার অফিসে পৌঁছানোর অনুরোধ জানিয়ে শুধু বললাম, আপনাদের যৌক্তিক দাবিসমূহ আমি বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেব। আমার এ বক্তব্যেই সভাকক্ষটি হাততালিতে কেঁপে ওঠে। সভা শেষে আমি বিকেল ৪টায় সদর দপ্তরে ফিরে আসি।
৫ অক্টোবর ২০০৬, বৃহস্পতিবার। সকালে অফিস করে দুপুরের পর শুক্র-শনি বন্ধের দুদিন ঢাকায় অবস্থানের জন্য কমিশনারের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে অনুমতি পাওয়ায় স্টেশন লিভ করি। ঢাকায় অবস্থানকালে আমার কিছু জরুরি কাজ ছিল, সেগুলো সম্পন্ন করি। অতঃপর রবিবার ভোরে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে সকাল ৯টায় হবিগঞ্জ ফিরে আসি।
রমজানের শান্ত সকাল, শরতের শেষের আকাশ-বাতাস। বেশ একটা মোলায়েম পরিবেশ। আমি অফিসে গেলে আমার সহকর্মী তিন এডিসি সৌজন্য সাক্ষাতে আসেন। তাঁদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করি। ভালোমন্দ খোঁজ খবর নিই। তাঁরা চলে গেলে আমি আমার রুটিনওয়ার্কে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
সাড়ে ১১টার দিকে আমার পূর্বপরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির (পরে তিনি এমপি হন) সাক্ষাতে আসেন। তিনি ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বৈদ্যেরবাজার ঈদ-পুনর্মিলনী সভায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সাথে মঞ্চে ছিলেন। সেদিনের গ্রেনেড হামলায় কিবরিয়া সাহেব এবং আরও ৪ জন মৃত্যুবরণ করেন। আহত হন শতাধিক। আহতদের মধ্যে তিনি মারাত্মকভাবে জখমী ছিলেন। ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন। তবে তাঁর দেহে এখনও নাকি কয়েকটি স্পিøন্টার রয়ে গেছে, যা নিয়েই তাঁকে বাঁচতে হচ্ছে। সেদিনের সেই ঘটনার তিনি কিছু বর্ণনা দেন। আমি তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি এবং এমন মর্মন্তুদ ঘটনার জন্য সমবেদনা জানাই। তিনি চলে গেলে আরও কয়েকজন ভিজিটর এলেন। কমবেশি তাঁদের সমস্যা শুনলাম। একনাগাড়ে ৪টা পর্যন্ত অফিস করে বাসায় ফিরে আসি।
পরের দিন অফিস হয়ে সকাল ১১টায় স্টাফ অফিসারকে সাথে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত সৌজন্য মতবিনিময় সভায় যোগদানের জন্য মাধবপুর উপজেলায় যাই। (চলবে…)