প্রভাষক উত্তম কুমার পাল হিমেল
প্রতি বছর শরৎকালে সার্বজনীন শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হলেও এ বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে হেমন্তকালে। মন-প্রাণ রাঙানো হেমন্তকালে আনন্দময়ীর ঘটেছে আগমণ। দশভূজা শারদীয়া মায়ের পূজোর আনন্দ হেমন্তের আনন্দকে কোটি গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। দূর্গতিনাশিনী দেবী শ্রীশ্রী দুর্গা মায়ের পূজোয় মহাআনন্দের চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। জগৎ জননীর পূজোয় প্রত্যেক মানুষ শান্তি সুখের দোলায় দুলছে। সারা বিশ্বে ৫ দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য ভাবেই শারদীয় দুর্গাপূজা আয়োজিত হচ্ছে। পূজোর ক্ষণে কল্যানদায়িনী, মঙ্গলময়িনী শ্রীশ্রী দুর্গা মায়ের শ্রীরাঙ্গাচরণে সকলেই সবিনয় প্রার্থনা জানায় বসবাসযোগ্য সুন্দর এক পৃথিবী গড়ার। সবার আকুল প্রার্থনা, এই ধ্বংসপ্রাপ্ত অন্ধকার পৃথিবীকে আলোময় যেন করেন মহামায়া দেবী শ্রীশ্রী দেবী দুর্গা।
নীল আকাশ। সমস্ত আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের দল আপন মনে খেলা করছে। মেঘ বিলাসী, মেঘ পিয়াসী আমরা দেখছি সেই আকাশ। রাতের আকাশ তারায় তারায় মুখর। চাঁদ বিলায় মিটিমিটি আলো। দিনের সূর্য মনমাতানো আলো ছড়ায় ভূবনে। শারদ প্রাতে আর শরতের দিনে এতো মায়া মমতা কার না ভালো লাগে। কার না ভালো লাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিউলী ফুল দেখতে। কার মন চায় না খুব সাদা কাশফুল অবলোকন করতে। শরৎ মানেই শিউলী আর কাশফুলের ছড়াছড়ি। মধুময় গন্ধের সমাহার। আর এ অভূতপুর্ব সময়েই মহিষাসুরমর্দিনীর আবির্ভাব ঘটেছে। কৈলাস হতে এসেছেন মা দুর্গা। শারদীয় দুর্গাপূজা বাঙালী হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। তবে বসন্ত কালেও এই পূজা হয়। যা বাসন্তি দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। দুর্গা পৌরাণিক দেবী। মানুষের দুর্গতি নাশ করেন বলেই তিনি দুর্গা। আবার দুর্গা বা দূর্গম নামের এক দৈত্যকে বধ করার কারণেও তাকে দুর্গা বলা হয়। পূরানে রয়েছে, মহিষাসুর স্বর্গরাজ্য দখল করে নিলে দেবতারা বাধ্য হন স্বর্গ ছাড়তে। স্বর্গ রাজ্য ফিরে পেতে বিষ্ণুর নির্দেশে দেবতারা তাদের তেজশক্তি একত্র করেন। এ তেজপূর্ণ থেকে যে দেবীর জন্ম হয়, তিনিই দুর্গা। আর তাই তিনি শক্তি রূপিনী, মহামায়া, দশ হাত বলে দশভূজা। তার বাহন সিংহ বলে সিংহবাহনা, মহিষাসুরকে বধ করেছেন বলে মহিষমর্দিনী- এমনও অনেক নামের অধিকারিনী তিনি। পূরানে পাওয়া যায়, বসন্ত কালে দুর্গাপূজা করে রাজ্য পেয়েছিলেন রাজা সুরথ। কৃর্তি বাসের রামায়নে রয়েছে, রাবন বধের জন্য শরৎকালে দেবীর পূজা করেছিলেন সুরথ। বঙ্গদেশে কবে থেকে দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু তা সঠিক করে বলা যায় না। ধারণা করা হয়, দশম কিংবা একাদশ শতকে স¤্রাট আকবরের রাজত্বকালে রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ন, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র জাকঁজমকের মধ্য দিয়ে পূজা করলে এর বিকাশ শুরু হয়। অষ্ঠাদশ শতকের শেষ দিকে শাসক ইউরোপীয়রা আমন্ত্রিত হতেন পূজোয়। আমাদের মানসপটে তাই পূজো এলে ভেসে ওঠে নানা উপাদান। ফুল, দুর্বা, তুলসিপত্র, বিল্লপত্র, আতপচাল, ধুপদীপ, ঢোল, কাসর, শংখ এবং পুরোহিতের মন্ত্র। পূজোয় পাঁচ পুরুষ, দশ পুরুষ ধরে প্রতিমা বানানোর কারিগররা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজান দেবী দুর্গাকে। মধুময় সুরের উলুধ্বনি শাকের আওয়াজ, ঢাক কাসরের ধুপধানি নাচ, নাড়কেল, তিলের নাড়–, মোয়া, ধুপধুনো, মিটাই, মন্ডা, পায়েস, খিচুড়ি, আরতির ধোয়া ও বাতাশে নাড়– সন্দেশের মিষ্ঠি গন্ধ মনে করিয়ে দেয় গ্রাম বাংলায় ও শহরের অলিতে গলিতে চলছে শারদীয় দুর্গোৎসব। এতো সব আয়োজন সবার মন-প্রাণ শীতল-সজিব করে রাখে সারাক্ষণ। দুঃখ-কষ্ঠ, চরম হতাশা, গ্লানি ও হাহাকারের মাঝেও জগজ্জননী দুর্গা মা আসেন পূজো নিতে। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে পূজো শুরু হয়ে চলে একটানা পাঁচদিন। কিন্তু এ বছর পূজোর শুরু কার্তিকের প্রারম্ভে শুক্লপক্ষে। দশভূজা তার চার সন্তান কার্তিক, গণেশ, লক্ষী, ও স্বরস্বতী এবং দুই সখী বিজয়া ও জয়াকে সঙ্গে নিয়ে আসেন পিতৃগৃহে নাইওরে। এছাড়া সঙ্গে আসেন তার স্বামী শিব। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং সার্বজনীন উদ্যোগে শারদীয় দূর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়। মানুষ পূজো মন্ডপ সাজান বর্ণাঢ্য ভাবেই। আলোকসজ্জা ও সাজসজ্জার কমতি রাখেন না কেউই। নতুন জামা কাপড়, শাড়ী, ধুতি, পাজামা-পাঞ্জাবী, চুড়ি, শাঁখা-সিঁদুর ও পুরোহিতের মন্ত্র উচ্ছারণের ধ্বণিতে পুজো প্রাঙ্গণ হয় মুখরিত। মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্ঠমী। মহাঅষ্ঠমীর দিন কুমারী পূজা হয় ও মহানবমী এই পাঁচদিন শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষ ও আবাল বৃদ্ধ বণিতা সর্বস্তরের মানুষ দুর্গোৎসবের আরাধনায় ব্যতিব্যস্ত থাকেন। আনন্দ উল্লাসে মুখর হয় জনপদ।
প্রতি বছর আশ্বিন মাসে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হলেও এ বছর পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে কার্তিক মাসের শুরুতে। এ উৎসব বিশ্বের সকল মানুষের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি, সার্বজনীন শারদীয় উৎসবে এই হোক সকলের চাওয়া।