স্মরণ
আব্দুল আউয়াল তালুকদার
আগস্ট মাস শোকের মাস। বাঙালি জাতির জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের মাস আগস্ট। সব সময় মনের ভিতরে ঘৃণা আর ক্ষোভ কাজ করে কি অপরাধ ছিল এই মহান পুরুষটির? তার অপরাধ ছিল তিনি ভুল করেছিলেন বাঙালি জাতিকে বিশ্বাস করে আর অপরটি ছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র নির্মাণে তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তাই আগস্ট মাসে সব সময় চেষ্টা করি নিজেকে শোকের মাসের মত উদযাপন করতে। বিয়ে সাদী বা কোন দাওয়াতে বা অন্য কোন সামাজিক কর্মকান্ডে আগস্ট মাস সব সময় মাথায় থাকে। আগস্ট মাস আমার কাছে আপনজন হারোনোর মাস। আমার বাবা ছাত্র জীবন থেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সক্রিয় থেকেছেন। কৃষক প্রজা পার্টি করতেন, মুসলিম লীগের কর্মী ছিলেন। কিছুদিন হবিগঞ্জ পোস্ট অফিসে কাজ করেছেন যেহেতু বড় ভাই পোস্ট মাস্টার ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে চাকুরিতে যোগদান করেন। চাকুরির সুবাদে ঢাকায় অবস্থান নেন। যেহেতু আমার বাবা রাজনৈতিক সচেতন মানুষ তাই চাকুরির পাশাপাশি তৎকালীন সময়ে ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। পূর্ব পাকিস্তান আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে শেখ মুজিবুর রহমান যোগদান করলেন। আমার বাবার সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সখ্যতা গড়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে। বঙ্গবন্ধুর সকল রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আমার বাবা নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। ঢাকা ও ঢাকার বাহিরে সকল সভা সমাবেশে আমার বাবার সরব উপস্থিতি ছিল। এভাবে পর্যায়ক্রমে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ট কর্মী হয়ে ওঠেন। ১৯৪৯ সালে ২৩ শে জুন ঢাকায় রোজ গার্ডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাতে আমার বাবা উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগের সকল সভা সমাবেশে নিয়মিত অংশ গ্রহণ করতেন। আওয়ামীলীগের পোস্টার লাগানো লিফলেট বিতরণ, মাইকিং করা, পথসভা, মিছিল মিটিং এ ও নেতাদের সাথে গণসংযোগ করা ইত্যাদি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য আমার বাবা চাকুরী ছেড়ে দেন। আমার মায়ের চাকুরির বেতন দিয়ে তিনি চলতেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা করলে সারা বাংলায় বঙ্গবন্ধুর সাথে ঘুরে বেড়ান তখন জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমার বাবার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের দুরদর্শীতার কারণে সকল নেতাদের কাছে “বঙ্গবন্ধুর নিম্বর” হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুও আমার বাবার কথা সকল নেতাদের বলতেন। ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি হবিগঞ্জ ও সিলেট শহরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করতে হবিগঞ্জ ও সিলেটে ছুটে আসেন। সিলেট জেলা ও বিভিন্ন মহকুমা থানা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালু করার জন্য ঘুরে বেড়ান। ১৯৭০ সালে নিবার্চনে আমার পিতা হবিগঞ্জের সকল আসনে আওয়ামীলীগ বিজয়ী হওয়ার জন্য কাজ করেন। আওয়ামীলীগে হবিগঞ্জ মহকুমায় পাড়া মহল্লা ইউনিয়নে ও থানা সংগঠিত করার কারণে ১৯৭০ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী আওয়ামীলীগের হাতে নিয়মতান্ত্রিক হস্তান্তরের পরিবর্তে নানান ষড়যন্ত্র চক্রান্ত শুরু করে।
পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ বাংলার মানুষদের উপর হত্যাকান্ড চালায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার মানুষ প্রতিরোধ হামলা করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অর্থ হবিগঞ্জ মহকুমার ট্রেজারি থেকে সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের সহায়তায় আমাদের গ্রামের বাড়ী ভাদৈ এবং শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশন রোডে দোকান লুট হয়। আমার বাবাকে হত্যা করার জন্য মাধবপুরে সীমান্তে এলার্ট জারি করা হয়। পরবর্তীতে বোরকা পড়ে সেপ্টেম্বর মাসে ভারতে চলে যান। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে কাজ করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলে তিনি দেশে ফিরে এসে দেশগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিমন্ডলে আমার বাবার কষ্ট ও ত্যাগের মূল্যায়ন তিনি পেয়েছিলেন জাতির জনকের কাছ থেকে। সকল রাজনৈতিক বড় বড় পদবীধারী নেতাদের মধ্যে থেকেও মহকুমার সকল প্রশাসনিক সরকারি কমিটিতে আমার বাবার নাম ছিল। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের ৩ সদস্য যাচাই বাছাই কমিটিতে সদস্য ছিলেন আমার পিতা অথচ তিনি নিজেই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেননি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমার বাবাকে হবিগঞ্জ রেডক্রস সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করলে আমার বাবাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়। বঙ্গবন্ধুর কাছে আমার বাবার আদর ও ¯েœহ ছিল আলাদা। তাই হবিগঞ্জের তৎকালীন সময়ে অনেক নেতা ঈর্ষা করতেন আমার বাবার বিরুদ্ধে নানান ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করতেন। আমার বাবার বিরুদ্ধে বললেই বঙ্গবন্ধু বলতেন আমি সারা বাংলাদেশের কত পাগল নিয়ে চলি তোমরা হবিগঞ্জে একজন নিয়ে চলতে পার না, আমার নিম্বরকে আমি বাদ দিতে পারবো না সে আমার দুর্দিনের রাজনৈতিক কর্মী।
ওয়ান ইলেভেনের সময় যখন আর্মির শাসন ক্ষমতায়া ছিল তখন একবার আমার বাবা সারাজীবনে বন্ধু সহকর্মী জনাব এনামুল হক মোস্তফা শহীদ চাচাকে জিজ্ঞেস করছিলাম চাচা আপনি আর মানিক চৌধুরী চাচার নেতৃত্বে কেন আমার বাবার বিরুদ্ধে ভুয়া ও মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছিলেন। জবাবে চাচা আমাকে বললেন তোর বাবাকে বঙ্গবন্ধু নিজের সন্তানের মত আদর ¯েœহ করতেন। তোর বাবা আমাদের পাত্তা দিত না তাই রাজনৈতিক ঈর্ষার জন্য আমরা অভিযোগ করেছিলাম। যেদিন অভিযোগ দিতে গিয়েছিল সেদিন তারা গিয়ে দেখে বঙ্গবন্ধু চেয়ারে বসা আর তোর আব্বা চেয়ারের পিছনে দাঁড়ানো।
বঙ্গবন্ধু তাদের ভৎর্সনা করে বিদায় দিলেন। জাতির জনকের নির্মম হত্যাকান্ডের পর আমার বাবা হবিগঞ্জ শহরে প্রথম প্রতিবাদ করেছেন এবং গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরবর্তীতে জেল থেকে বেরিয়ে আবার বঙ্গবন্ধুর পরিবারে সদস্যদের জন্য মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেন হবিগঞ্জ শহরের সওদাগর জামে মসজিদে। মিলাদ মাহফিল পড়ানোর কারণে সেদিন রাতে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর কয়েকবার ডিটেনশন ভোগ করে কারাবরণ করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর আওয়ামীলীগ ছিল কয়েকভাগে। আওয়ামীলীগকে আবার একত্রিত করার ক্ষেত্রে আমার বাবা বলিষ্ট ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধু বিহীন আওয়ামীলীগকে আবার পুনর্গঠনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। আমার বাবার কোনদিন পদের মোহ ছিল না। তিনি বলতেন আমি বঙ্গবন্ধুর ¯েœহধন্য পেয়েছি আমি আওয়ামীলীগের একজন হয়ে থাকতে চাই। তাই কোনদিন দলের পদ পদবীতে লোভ ছিল না। তিনি সব সময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করতেন। সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দীক্ষা যেভাবে পেয়েছিলেন তিনি গণমানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন।