আমি এখনো চমৎকৃত হই সেই ডাচ রমণীর স্বতঃপ্রণোদিত সহায়তার কথা ভেবে

জালাল আহমেদ

পরদিন ২৩ মে সকালে আমার প্রথম সেশন শুরু হল আন্তর্জাতিক ভূমি পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন ইন্সটিটিউটে (আইআইএলআরআই /ওওখজও)। ইনস্টিটিউট বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মধ্যেই একটি স্বতন্ত্র ভবনে। আমি আগে উল্লেখ করেছি যে নেদারল্যান্ডসকে আমরা সবাই সাগর সমতলের নিচের দেশ হিসাবে চিনি। ছোট্ট দেশ এবং বসবাস উপযোগী ভূমির পরিমাণও কম তাই ঘনবসতি। সম্ভবত ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। সমুদ্র থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার বা রিক্লেইম করে কিভাবে জনবসতিতে রূপান্তর করা হয়েছে তার সবচেয়ে সফল উদাহরণ দ্য নেদারল্যান্ডস। যে বিষয়টা আসার আগে ধারনায় ছিলনা তা হল “ওয়াটার টেবল” অনুসরণ করা। নেদারল্যান্ডসের কোথাও কৃষি কাজে সেচের ব্যবহার করা হয় না। পুরো দেশে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় পানির স্তর মেইন্টেইন করে কাজটি করা হয়। ফলে যে কোন ফসল বা বৃক্ষ-লতা মাটির নির্দিষ্ট স্তরে পানির নাগাল পেয়ে যাচ্ছে। পুরো দেশ জালের মত নালা/খাল ছড়ানো আর পুরো দেশেই মাটির নিচে ছিদ্রযুক্ত পাইপের জালও ছড়ানো। ফলে ভূমির উপরিতল থেকে পানি সহজে খালে চলে যায় আর সারা দেশে খালের পানির উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এই ইন্সটিটিউট এবং ডেলফ এর ইন্সটিটিউট অফ হাইড্রোলিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইএইচই) এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
প্রথম দিনের সেশনে আমাদের মূলতঃ নেদারল্যান্ডস এর সংগে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল এবং এই ইন্সটিটিউট কি কাজ করে তার একটা ধারণা দেয়া হল। জানা গেল যে নেদারল্যান্ডসের পাঁচভাগের তিনভাগ ভূমি অর্থাৎ ৬০% ভূমি সমুদ্র সমতলের নিচে। আমরা যখন রাস্তায় হাঁটছি বা গাড়ী চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি তখন কিন্তু এই বিষয়টি বুঝতে পারছি না। দিনটি ছিল শুক্রবার, পরের দুই দিন ছুটি। তাই আমরা ছুটির দিন কাটানোর পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। টিম মিটিং এ সিদ্ধান্ত হল যে পরদিন শনিবার আমরা যাব নেদারল্যান্ডসের অন্যতম রাজধানী দ্য হেগ এ। উইকিপিডিয়াতে গেলে দেখা যায় যে রাজধানী বলা হচ্ছে আমস্টারডামকে আর সরকারের আসন দ্য হেগ। বিকেলে হোটেলে ফিরে জানা গেল যে জেলা প্রশাসক নোয়াখালী এসে পৌঁছেছেন। আমি তাঁর রুম নাম্বার জেনে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি অসুস্থ, বিছানায়। পরদিন আমরা যাব হেগ এ, সংগত কারণেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তিনি প্রস্তাব করলেন আমরা যেন না যাই। তাঁর অসুস্থতার কারণে আমি তাঁর এডিসি হিসেবে থেকে গেলেও বাকি বারো জন তো তা’ নয়। অসুস্থতার কারণ যা বুঝতে পারলাম অনভ্যাস। তিনি এক সময় নরসিংদী জেলায় এডিএম ছিলেন। প্লেনে তাঁর সহযাত্রী ছিল নরসিংদীর দুই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। তিনজনে একসংগে ব্যাংকক এয়ারপোর্ট এবং বিমানে প্রাণভরে কঠিন পানীয় গলাধঃকরণ করেছেন। অনভ্যাসের ফোঁটা কপালে চড়চড় করে। কোথায় থামতে হবে না জানার কারণে এই অসুস্থতা।
আমার প্রথম বিদেশ সফর হলেও ওইদিনের হেগ সফরে রাহবার হলাম আমি। নিকটেই হাঁটা দূরত্বে স্টেশন। সবাই মিলে ছাপা ম্যাপ হাতে পদব্রজে স্টেশনের দিকে রওনা করলাম। সে যুগে গুগল ম্যাপ ছিল না। ফলে যে কোন জায়গায় গেলে আমার প্রথম কাজ হতো একটা লোকালিটি ম্যাপ সংগ্রহ করে নেয়া এবং এই ছাপানো ম্যাপ ধরে আমি কাউকে জিজ্ঞেস না করেই যে কোন ঠিকানায় পৌঁছে যেতে পারতাম। স্টেশনে গিয়ে প্রথম যে চমক চোখে পড়লো তা হলো বিশাল সাইকেল পার্কিং। আমরা সবাই এটা জানি যে নেদারল্যান্ডসের মানুষ প্রচুর সাইকেলে চড়ে কিন্তু ঐ দৃশ্য ছিল তার চাইতেও বেশি কিছু। শত শত সাইকেল দাঁড়িয়ে আছে, মালিকরা সাইকেল এখানে রেখে ট্রেনে আমস্টারডাম বা অন্য কোথাও কাজ করতে গিয়েছে, ফিরে এসে সাইকেল নিয়ে ঘরে ফিরবে। স্টেশনে গেলাম টিকেট কাটতে কাউন্টারে এক মহিলা, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম যে আমস্টারডাম যাবার কোন ট্রেন আছে কি না? বললো যে কিছুক্ষন পরেই একটা ট্রেন আছে। আমরা ১৩ জনের টিকেট কাটবো। মহিলা জিজ্ঞেস করলো যে আমরা একসংগে কি না, বললাম যে হ্যাঁ। বললো যে তাহলে তোমরা গ্রুপ টিকেট করো, সস্তা হবে। আমি বললাম ঠিক আছে, তাই দাও। আরও জিজ্ঞেস করলো যে আমরা একসংগেই থাকবো কি না এবং একসংগে ফিরবো কি না? বললাম যে হ্যাঁ, একসংগেই ফিরবো। তখন বললো যে তাহলে তোমরা গ্রুপ রিটার্ন টিকেট নাও, আরো সস্তা পড়বে। এভাবে প্রায় অর্ধেক খরচে আমাদের টিকেট হয়ে গেল। আমি এখনো চমৎকৃত হই সেই ডাচ রমণীর স্বতঃপ্রণোদিত সহায়তার কথা ভেবে।
ট্রেন থেকে নেমে প্রথমেই আমরা যাই হেগ এর অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য উত্তর সাগর সৈকত পিয়ার এ। পিয়ার ঘুরে এসে কিছুক্ষন বীচে সময় কাটানো। এর আশেপাশেই ছিল নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত ন্যুড বিচগুলো। ওখানে পর্দা রক্ষা করে একাধিক ন্যুড বিচ, ফলে বাইরে থেকে দেখার উপায় ছিল না, প্রাইভেট বিচ এর মত ঘেরার ভেতরেই নগ্নতা। যারা আগ্রহী তারাই যথাযথ পোষাক বা নিপোষাকে যেতে পারে। বিচে আমাদের দেশের মত কিছু দোকানপাটও ছিল, মূলত রঙচঙে বিচ পোশাক ও অন্যান্য বিচ এক্সেসরিজের। দাম ছিল সহনীয় পর্যায়ে। তারপর কাছেই উত্তর ইউরোপের তখনকার বৃহত্তম ক্যাসিনো, হল্যান্ড ক্যাসিনো কাউকে কাউকে টানলো। আমার নিজের ক্যাসিনো প্রীতি নাই, ২০০০ সালে সুযোগ পেয়ে মেলবোর্ন ক্যাসিনোতেও যাইনি। যারা ক্যাসিনোতে গিয়েছিলেন কিছু ডাচ গিল্ডারস হারিয়ে তারা ফিরেও আসলেন। দুপুরে খোলা রেস্টুরেন্টে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এখানে বলে নেয়া ভালো যে দিনটি মে মাসের ২৩ তারিখ, রীতিমতো গরমকাল। নোয়াখালীতে বসে ডাচ টিমলিডার আরেন্ড ভেন রাইজেন বলেছিল যে আপনারা খুব ভালো সময়ে যাচ্ছেন, একটা হাফ শার্টেই কাজ চলবে। ফলে আমি শীত নিবারক হিসাবে একটি সাধারণ স্যুট আর একটা হাফ সোয়েটার নিয়ে আসছি। অথচ এখানে শার্টের উপর হাফ সোয়েটার পরে তার উপরে কোট পরেও শীত থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছিল না। উত্তর সাগরের একটানা দক্ষিণমুখী বাতাসে গরমের মাসেও শীতের অনুভূতি বাড়িয়ে দেয়। এরপর থেকে যে কোন বিদেশ সফরে আমি আরেন্ড এর কথা মনে করেই লাগেজ প্যাকিং করি। ভ্রমন শেষে ট্রেনযোগে গ্রুপ রিটার্ন টিকেট দিয়ে ফিরে আসি। মাঝখানে চারআনা খরচ করে রেস্টরুম ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। ফিরে এসে রাতের খাবার সেই একই সুরিনামী রেস্টুরেন্টে তবে এবার সংগে ডাল ভাত খাবার লোভে অনেকেই ছিল।