প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বললেন
খুনের দায় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের হাত কেটে ডোবায় পড়ে থেকেও আমীর আলীর শেষ রক্ষা হয়নি ॥ হত্যায় ব্যবহৃত ছোরা ও নিহত অঞ্জলীর মোবাইল ফোন উদ্ধার
এসএম সুরুজ আলী ॥ বাহুবলের দিগাম্বার বাজারে গভীর রাতে মা-মেয়েকে গলা কেটে হত্যার নেপথ্যে ছিল তাদের ঘরে থাকা ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা ও দেড় ভরি স্বর্ণালংকার চুরি। একই ভবনের দ্বিতীয় তলায় বসবাসকারী সবজি বাজারের শ্রমিক আমীর আলী ও তার দুই সহযোগী এই হত্যার ঘটনা ঘটায়। পরে আমীর আলী নিজেই নিজের হাত কেটে ঘরের পাশে একটি ডোবায় পড়ে থাকে যাতে সবার বিশ্বাস হয় ওইদিন আসলেই সেখানে চুরির ঘটনা ঘটেছিল।
শনিবার বিকেলে হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা আক্তারের আদালতে হত্যাকারী আমীর আলী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে হত্যার দায় স্বীকার করে এই তথ্য প্রদান করে। এ ব্যাপারে শনিবার রাত সাড়ে ৭টায় হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা প্রেসব্রিফিংএ এই তথ্য নিশ্চিত করেন
পুলিশ সুপার বলেন, আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি এবং পিবিআই, হবিগঞ্জ এবং ক্রাইম সিন ইউনিট, সিআইডি, সিলেটকে সংবাদ প্রদান করলে তারা ঘটনাস্থলে এসে আলামত সংগ্রহে সহায়তা করেন। উদ্ধারকৃত দুটি মরদেহের মাঝে অঞ্জলি মালাকারের গলাকাটা, ঠোট, গাল ও পেটে রক্তাক্ত কাটা জখম এবং তার মেয়ের পূজা রায়ের গলাকাটা পাওয়া যায়। মৃত অঞ্জলি মালাকারের স্বামী সনজিত (৪৫) জানায় ঘটনার সময় সে বাড়িতে ছিল না। কাঁচা মরিচ ক্রয়ের জন্য সুনামগঞ্জ জেলায় গিয়েছিল এবং সকালে এসে ঘরে প্রবেশ করে তার স্ত্রী ও মেয়ের রক্তাক্ত লাশ দেখতে পায়। সে আরও জানায় তার ঘরে থাকা ১ লাখ নব্বই হাজার টাকা, তার স্ত্রীর হাতে থাকা দেড় ভরি ওজনের স্বর্ণের বালা এবং তার স্ত্রীর ব্যবহৃত একটি স্যামপনী এন্ড্রয়েড ফোন ঘরে পাওয়া যায়নি। তদন্তকালে ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে উক্ত বাড়ির দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া সিলেটের শাহপরান থানার চৌকিদিঘি এলাকার আলমগীর এর ছেলে আমির আলীকে (৩০) গ্রেফতার করা হয়। ঘটনা তদন্তকালে ও আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় অঞ্জলীর স্বামী ও মামলার বাদী সনজিত এবং আমীর আলী পূর্ব পরিচিত। তারা দু’জন একসাথে শ্রমিকের কাজ করত। সনজিতের রেফারেন্সে অনুমান ৩ মাস পূর্বে উক্ত বাসার দ্বিতীয় তলার বাসা ভাড়া নেয় আমীর আলী। সে উক্ত বাসাতে স্ত্রী ও ছেলে মেয়েসহ বসবাস করত। কিছুদিন পূর্বে তার টাকার প্রয়োজন হলে সে সনজিতের বাসাতে এসে ৩ হাজার টাকা ধার নেয় এবং সে তখন জানতে পারে সনজিতের ঘরে প্রায় ২ লাখ টাকা রয়েছে। এই টাকাগুলি এবং ঘরে থাকা স্বর্ণালঙ্কার চুরি করার জন্য সে মতলব করতে থাকে। এ বিষয়ে সে তার এক ঘনিষ্ট সহযোগির সাথে আলোচনা করে। গত ১৮ মার্চ সনজিত কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য সুনামগঞ্জে যায় এবং তার ফিরতে সকাল হবে সে জানতে পারে। সনজিত বাড়িতে না থাকার সুবাদে সে টাকাগুলি নেয়ার জন্য তার সহযোগি বাহুবল উপজেলার নোয়াঐ গ্রামের মৃত মহিদ উল্ল্যার ছেলে মনির মিয়া (৪৭) এবং অন্য একজন সহযোগির সাথে ঐদিনই পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক রাত ১০টায় সময় অঞ্জলীর বাসার প্রধান সুইচ থেকে বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়ে পুরো বাসাটিকে অন্ধকার করে ফেলে। রাত ২টায় আমির আলীর ঘরে একত্রিত হয় তিন হত্যাকারী। সনজিত দাসের ঘরের দরজা খোলার জন্য আমির আলী কৌশল অবলম্বন করে। সে সনজিত এর স্ত্রী অঞ্জলি মালাকারের মোবাইল ফোনে রাত অনুমান ৩টা ১০ মিনিটে কল দিয়ে বলে তার বাসায় চুরি হয়েছে এবং তার টিভি, সেলাই মেশিন চুরি করে নিয়ে গেছে। অঞ্জলি মালাকার যেন তার বাসায় এসে চুরির বিষয়টি দেখে এবং এটি বিশ^াস করানোর জন্য আমির আলী একটি রশি উক্ত বাড়ির ছাদে বেঁধে অঞ্জলি মালাকারের বারান্দার সামন দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। অঞ্জলি মালাকার তার ঘরে না আসায় আমির আলী সঞ্জিতকে ফোন দিয়ে বলে আমার ঘরে চুরি হয়েছে অথচ তোমার স্ত্রী আমাকে দেখতে এলো না এবং সঞ্জিত বর্তমানে কোথায় আছে তা জানতে চায়। সনজিত জানায় সে তখন সুনামগঞ্জে আছে। এরপর সঞ্জিত তার সহযোগিসহ তিনতলায় অঞ্জলি মালাকারের দরজার সামনে যায় এবং অঞ্জলি মালাকারের দরজায় টুকা দিয়ে দরজা খুলতে বলে। অঞ্জলি মালাকার তার কথায় বিশ^াস করে দরজা খুললে তারা তিনজন ঘরে প্রবেশ করে অঞ্জলি মালাকারের মুখে চাপ দিয়ে ভিতরের কক্ষে নিয়ে যায় এবং তার মুখে ও শরীরে আঘাত করে তার গলা কেটে তাকে হত্যা করে। এ সময় ঘরে থাকা অঞ্জলি মালাকারের মেয়ে পূজা রানী দাস ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে কান্না করতে থাকলে তারা তাকেও গলা কেটে হত্যা করে। এরপর তারা অঞ্জলি মালাকারের ঘরের ড্রয়ারে থাকা অনুমান ১ লাখ নব্বই হাজার টাকা ও অঞ্জলি মালাকারের ব্যবহৃত ১টি এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। তারা হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছোরা ও মোবাইল ফোনটি ঘটনাস্থলের পাশে একটি ডোবাতে ফেলে দেয়। আমির আলীর বাসায় চুরি হয়েছে এবং আমির আলীকে যাতে সন্দেহ না করা হয় সে জন্য সে তার বাম হাতের পাতায় নিজেই কাটা দাগ সৃষ্টি করে এবং ডাকাতরা তাকে মেরে বাড়ির পাশে একটি জমিতে ফেলে রেখে গেছে বিশ^াস করার জন্য সে অজ্ঞান হওয়ার ভান করে জমিতে পড়ে থাকে। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরবর্তীতে হবিগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে প্রেরণ করেন।
পুলিশ সুপার আরও জানান, আসামী আমির আলীর স্বীকারোক্তি মতে এবং তদন্তকালে ঘটনার সাথে জড়িত মনির মিয়া (৪৭)’কে শনিবার দুপুরে বাহুবল মডেল থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে আসামীদের দেখানো মতে ঘটনাস্থলের পাশে একটি ডোবা হতে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছোরা, লুন্ঠিত মোবাইল ফোন এবং কিছু টাকা আসামী আমীর আলীর ঘর হতে উদ্ধার করা হয়। অপর সহযোগি আসামীকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
হত্যার পূর্বে অঞ্জলীকে ধর্ষণ করা হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, এ ব্যাপারে আসামী আমীর আলী কোন তথ্য দেয়নি। তবে ময়নাতদন্তে যাতে বিষয়টি পরীক্ষা করা হয় তার জন্য চিকিৎসককে বলা হয়েছে এবং চিকিৎসকরা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ল্যাবে প্রেরণ করেছেন।
এর আগে শুক্রবার রাতে বাহুবল মডেল থানায় অজ্ঞাত আসামী দিয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহত অঞ্জলী দাসের স্বামী ও পূজা দাসের বাবা সঞ্জিত দাস বাদী হয়ে শুক্রবার রাতে এই মামলা দায়ের করেন।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার ভোররাতে বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী ইউনিয়নের দ্বিগাম্বর বাজারে লামাপুটিজুরী গ্রামের সঞ্জিত দাসের স্ত্রী অঞ্জলী দাস (৩৫) ও তার মেয়ে পূজা দাস (৮) এর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ধর্ষণের পর এই হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সঞ্জিত দাস কাঁচা মালের ব্যবসা করেন। তিনি স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে দ্বিগাম্বর বাজারে তিন তলা একটি বাসায় ভাড়া হিসাবে বসবাস করে আসছিলেন। ঘটনার দিন রাতে তিনি ব্যবসার কাজে সুনামগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। বৃহস্পতিবার ভোরে তিনি বাসায় এসে দেখেন তার স্ত্রী ও মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।
পুলিশ সুপারের প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহফুজা আক্তার শিমুল, সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার পারভেজ আলম চৌধুরী, বাহুবল মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ কামরুজ্জামান, হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলী।