জালাল আহমদে
‘নিজেরা করি’ ‘নিজেরা খাই’
সিডিএসপি প্রকল্পভুক্ত এলাকা ছিল তখন সদর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ১৬টি মৌজায়। তখনো কবিরহাট, সূবর্ণচর বা সোনাইমুড়ি উপজেলা হয় নাই। এই ১৬টি মৌজার জন্য ভূমিহীন পরিবার নির্বাচন করা ও জমি নির্বাচন করা ছিল এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। সহকারী কমিশনার (ভূমি) সদর মোঃ জাফর আলম ছিল এক অসাধারণ কর্মকর্তা। যে কোন বিষয় দ্রুত বুঝে নিতে পারতো অর্থাৎ কুইক লার্নার আর ছিল ‘হরফুন মৌলা’, সকল কাজের কাজী। সত্যিকারের জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ বোধহয় সে ই পারতো। পূর্ববর্তী সহকারী কমিশনার আমীর হোসেনের কাছ থেকে দায়িত্ব নিয়ে সে খুব দ্রুত তাঁর কাজ বুঝে নেয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই চর এলাকার নিটিগ্রিটি আয়ত্ব করে ফেলে। আমি নির্দ্বিধায় তাঁর উপর নির্ভর করতে পারতাম। প্রকল্প অফিসের সোবহান সাহেবের সাপোর্টে এবং জাফর আলমের দক্ষতায় আমরা মৌলিক কাজগুলোসহ ‘রুলস অফ দ্য গেম’ সেট করতে সমর্থ হই। টিম লিডার অৎবহফ াধহ জরবংংবহও ছিল সহযোগী মনোভাবসম্পন্ন।
তারমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘প্লট টু প্লট’ সার্ভে এবং বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ার কোন পর্যায়ে ভূমিহীনদেরকে কোন সরকারী অফিসে না আনা। আমার পুরো সময় আমি এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছি। “প্লট টু প্লট সার্ভে” ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। কতবার যে চরের নেতাদের হস্তক্ষেপে, জেলা প্রশাসকের অনুজ্ঞায় এই সার্ভে বন্ধ করতে হয়েছে এবং কতবার যে কখনো নিজে গিয়ে কখনো জেলা প্রশাসককে সঙ্গে নিয়ে আবার তা চালু করা হয়েছে তার ইয়ত্বা নাই। একবার এক মৌজায় জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের অনুরোধে জরিপ বন্ধ করে দিলেন। আমি জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করলাম যে স্যার আপনি চলেন, দেখে আসেন যে আমরা কি করছি আর চেয়ারম্যানের কি সমস্যা।
আমরা গেলাম চর বাটা ইউনিয়নের (এখন সুবর্ণচর উপজেলায়) জোবায়ের বাজারে। জোবায়ের মিয়া কোথায়? জানা গেল যে সে চেয়ারম্যান আনম খায়রুল আনাম সেলিম (বর্তমান নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) ছেলে, দুই বছর বয়সী এক শিশু। জরিপের সমস্যা কি? আমরা রামের জমি শ্যামকে দেবার পাঁয়তারা করছি, রামের জমি জরিপে বন্দোবস্তযোগ্য হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রাম কোথায়? ওই হোথা! ভিন্ন মৌজা বা ভিন্ন জায়গায়। এই জমি কে চাষ করে? শ্যাম। শ্যাম কি ভূমির মালিক না ভূমিহীন? ভূমিহীন। ওই জমি কি রামের মালিকানায়? না, খাস। তাহলে এই জমি যেহেতু ভূমিহীন শ্যাম চাষ করে তাহলে এই জমি শ্যাম পাবে। আর রাম যেহেতু এই জমি ছেড়ে চলে গেছে, সে ভূমিহীন এবং খাস জমিতে বাস করে সেহেতু ঐ জমি রাম পাবে। বাস্তবে হয়তো রামের নামে জমি নিয়ে চেয়ারম্যান রামকে ঐ খাস জমিতে পাঠিয়ে দিয়েছে আরো একটা জমি নিতে।
এই খেলা নোয়াখালী জেলা সদরের অন্ততঃ সকল সম্পন্ন ব্যক্তির, দলীয় পরিচয় যাই হোক। এভাবে ১৬টি মৌজায় প্লট টু প্লট সার্ভে করে জমির প্রকৃত অবস্থা এবং অবস্থান ঠিক করা হয়। এর পর ভূমিহীন নির্বাচন। এটাও স্থানীয়ভাবে সাক্ষাৎকার নিয়ে এবং তদন্ত করে ঠিক করা। এক্ষেত্রেও স্থানীয়দের চাপকে নিউট্রালাইজ করতে হয়েছে। ভূমিহীনদের নামে বন্দোবস্ত নথি সৃজন এবং এতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযোজনের কাজগুলোও স্থানীয়ভাবে করা হয়। চর এলাকার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে এই কাজে ব্যবহার করা হয়।
বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল গুচ্ছগ্রামসমূহের সৃজন। আমরা অনেকেই গুচ্ছগ্রামের ইতিহাস শুরু করি ১৯৮৬ সালে ঝিনাইদহে জেলা প্রশাসক ১৯৭৩ ব্যাচের সদ্যপ্রয়াত আসাদুজ্জামান ভূঁইয়া’র গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে। অনেকে আবার সেনাশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের দেখা অসংখ্য স্বপ্নের একটি মনে করেন। যারা জানেন না তাদের জন্য, এরশাদ সাহেব সাধারণতঃ বৃহস্পতিবার রাতে স্বপ্ন দেখতেন তিনি নির্দিষ্ট কোন মসজিদে শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়ছেন। স্বপ্ন সত্যি করার জন্য তিনি শুক্রবারে ঐ মসজিদে হাজিরও হয়ে যেতেন। যদিও প্রটোকল অনুযায়ী এসএসএফ তাঁর স্বপ্ন দেখার বহু আগে থেকেই ওই নির্দিষ্ট মসজিদকে কেন্দ্র করে তাদের নিরাপত্তা বুহ্য রচনা করতো। প্রকৃতপক্ষে গুচ্ছগ্রামের সৃজন শুরু হয় বঙ্গবন্ধু’র সময়ে, ১৯৭৪ সালে নোয়াখালীর চর বাটায়। সেই গুচ্ছগ্রাম তখন অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত এবং বড় প্লটের উপর স্থাপিত। এসব গুচ্ছগ্রাম আমরা দেখতেও গিয়েছি।
মজা হল যে এসব গুচ্ছগ্রামে ‘নিজেরা করি’ নামে একটি এনজিও’র উপস্থিতি ছিল। ‘নিজেরা করি’ এসব চরে যা করতো তা তাদের রাজধানী’র ইমেজের সংগে ছিল বিপরীতধর্মী। সমস্যা শুরু হয়েছিল যখন আমরা গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের নামে মালিকানা হস্তান্তরের উদ্যোগ নেই। এসব গুচ্ছগ্রামের পরিবার প্রতি ৩ একর জমির মালিকানা ছিল যৌথ, যা আমাদের দেশের সংস্কৃতির সংগে যায় না। ২০ বছর পর পরিবারসমূহ বড় হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে মূল বরাদ্দ প্রাপক মারা গিয়েছে। এখন ব্যক্তিমালিকানা হয়ে গেলে এখানে ‘নিজেরা করি’র প্রভাব এবং বেনিফিট ক্ষুন্ন হবে। ‘নিজেরা করি’কে কৌতুক করে বলা হত ‘নিজেরা খাই’। তাদের হাত অনেক লম্বা ছিল এবং ঢাকায় বসেই তারা এডিসি (রেভিনিউ) কে বদলে দেয়। তবে দাতাদের পরামর্শে দুই মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজে প্রাক্তন এডিসি (রেভিনিউ) কে ফিরিয়ে আনতে হয় এবং তিনি এডিসি (সার্বিক) থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন যাতে ‘নিজেরা করি’র ‘নিজেরা করি, নিজেরা খাই’ বাঁধাগ্রস্ত হয় বলে তারা ‘খুশী’ হতে পারেননি।
প্রকল্পের অধীনে ২০টি গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠার জন্য টেন্ডার আহবান করা হয়। আমার ইউএনও যুগের অভিজ্ঞতা থেকে আমি সিদ্ধান্ত নেই যে কোন ঠিকাদার একাধিক গ্রামের কাজ পাবে না। এই নিয়ে স্থানীয় ঠিকাদারদের একটা শক্তিশালী গ্রুপের সংগে মতানৈক্য হল। তবে আখেরে দেখা গেল যে তথাকথিত সিন্ডিকেট ভাংগা সহজ নয়, একদিনের কাজও নয়। বিষয়টা সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং দীর্ঘদিনের অনুশীলনে সম্ভব হয়। গুচ্ছগ্রামগুলোর নির্মাণ কাজ চলতে থাকে। এদিকে ভূমি বন্দোবস্তের দাপ্তরিক প্রক্রিয়াও চলতে থাকে। নিবন্ধনের পর্যায়ে আসার পর এই নিবন্ধন কাজও কমিশনে সাব-রেজিস্ট্রারকে চরে নিয়ে গিয়ে করা হয়। এরপর বন্দোবস্ত প্রাপকদের মধ্যে জমির মালিকানা দলিল হস্তান্তর করা হয় জমি সংলগ্ন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন (ইপিসিএস ১৯৬৭ ব্যাচ) আনুষ্ঠানিকভাবে জমির মালিকানা দলিল হস্তান্তর করেন। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন অসাধারণ গুছানো বক্তা এবং আচরণে ছিলেন অভিভাবকসুলভ। তিনি আমাদের পুরো পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হন ও সন্তুষ্টিপ্রকাশ করেন। বরাদ্দ প্রাপকদের কাছ থেকে “কমিশনে রেজিস্ট্রেশন” এর খরচ ও সরকারের নূন্যতম প্রাপ্য জমির দলিল হস্তান্তর এর সময় যথাযথ রশিদ প্রদানের মাধ্যমে বুঝে নেয়া হয়।