জালাল আহমেদ
আমি প্রথম আদেশেই ২০ জন তহশীলদারকে বদলী করলাম
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) হিসাবে কাজ শুরু করলাম রাজস্ব বিষয়ে খুব কম অভিজ্ঞতা নিয়ে আর এমন এক জেলায় যা রাজস্ব জেলা হিসাবে খ্যাত। সহকারী কমিশনার ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার পদে কালেক্টরেটে কাজ করার সময় আমি বিভিন্ন শাখায় কাজ করলেও ভূমি হুকুম দখল শাখায় কাজ করিনি। তিন বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করেছি যেখানে রাজস্ব প্রশাসন ভিন্ন ধরণের। চাঁদপুরে রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা চার মাসের। আর বাংলাদেশে খুব কম সংখ্যক কর্মকর্তা আছে যাদের সেটেলমেন্ট ট্রেনিং হয় নাই, আমি তাঁদের এক জন। আমি কেস এনোটেশন না করা ম্যাজিস্ট্রেট আর সেটেলমেন্ট ট্রেনিং না করে এডিসি (রাজস্ব) নোয়াখালী এবং আরও পরে কালেক্টর। আমার জেলা প্রশাসক পদে ইন্টারভিউ এর প্রথম প্রশ্নই ছিল “আপনার তো সেটেলমেন্ট ট্রেনিং নাই!”
সহকর্মীদের কয়েকজনের কথা আগে উল্লেখ করেছি। জেলা প্রশাসক ছিলেন ১৯৭৩ ব্যাচের মশিউর রহমান, বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি। এডিএম ছিলেন আব্দুস সোবহান সিকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ইংরেজীর ছাত্র, বাড়ি বরিশাল। আরেক বরিশাইল্ল্যা ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোঃ তারিকুল ইসলাম। লোক প্রশাসন বিভাগে আমার ৪ বছর সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে অবলীলাক্রমে তুমি সম্বোধন করেই কথাবার্তা চলতো। আমাদের তিনজনের একটা ভালো বোঝাপড়া ছিল আর আমাদের কারোরই কোন ব্যক্তিগত এজেন্ডা ছিল না। ফলে নোয়াখালীর এডিসিদের নিয়ে আগে যে সব কিসসা কাহিনী শুনেছি আমাদের তিন বছর সময়কালে তা হয় নাই।
আমার সংগে আরডিসি বা রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর ছিল একেএম জাকির হোসেন ভূঁইয়া, সদরের এসি ল্যান্ড ছিল মো. জাফর আলম। এডিএলজি প্রথমে হুমায়ুন কবির পরে দিলীপ কুমার সাহা। এনডিসি ছিল একেএম বদরুল মজিদ। হাওলাদার জাকির হোসেন, শাহ আলম মৃধা, খোদেজা খানমসহ আরো অনেকে। খোদেজা’র স্বামী মোস্তফা কামাল ছিল এসি ল্যান্ড বেগমগঞ্জ।
নোয়াখালীকে রেভিনিউ ডিস্ট্রিক্ট বলা হয়ে থাকে, এর অন্যতম কারণ জেলার দক্ষিণাঞ্চল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলা সদর স্থানান্তরিত হয়ে মাইজদীতে আসে। ১৯০০ থেকে ১৯৬০ সময়কালে সারা দেশ “নোয়াখাইল্যা” মৌলভীতে ভরে যায়। নোয়াখালী’র দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বলা হত যে নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে গিয়ে তাঁর আগেই পৌঁছে যাওয়া নোয়াখালীর নাগরিকদের পেয়েছিলেন। ১৯১৯-১৯২১ এর ভাংগন আর ১৯৪৯-৫০ এর সেই বিপর্যয়ের পর ১০ বছরও কাটে নাই, ১৯৫৭ সালে লক্ষ্মীপুরের বামপন্থী রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ তোয়াহা রামগতিতে মেঘনার দুই পয়েন্টে বাঁধ দেয়া শুরু করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড এর সম্ভাবনা দেখে কাজটি গ্রহণ করে ও শেষ করে। এই বাঁধের ফলে ১৯৫৭ সালের পর থেকেই নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে চর জাগতে শুরু করে এবং বিচ্ছিন্ন চরগুলো যুক্ত হতে শুরু করে। রামগতি-চর আলেকজান্ডার যুক্ত হয়ে পুরো সুধারামকে জাগিয়ে তোলে।
রামগতি-সুধারাম-কোম্পানীগঞ্জ মিলে অন্ততঃ ২০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জেগে উঠে। হাতিয়া সরতে থাকে দক্ষিণে। ১৯০০ সালের হাতিয়ার উত্তরাংশ এখন সুবর্ণচর উপজেলার দক্ষিণাংশ। এর আগে প্রাক্তন এডিসি, পরবর্তীতে ডিসি নোয়াখালী, মাহবুবুর রহমানের কথা লিখেছি, যিনি বলেছিলেন বাসা থেকে সমুদ্র ২০০ গজ দূরে! আমি যখন দিঘীর উত্তর পাড়ের বাংলোতে থাকি তখন বাগ্যারঘোনা বা চরবাটা সি ট্রাক ঘাট ছিল ৪০ কিলোমিটার দূরে। আর বাগ্যারচরে রাস্তা হবার পর এখন বাসা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্র। একটু চিন্তা করে দেখেন এই পরিবর্তনটা। বাংলাদেশ খুব কম প্রকল্প এমন ইম্প্যাক্ট রেখেছে বলে আমার মনে হয়। যদিও এটি খুব স্বল্প পরিচিত এক প্রকল্প এবং এর উপর তেমন কোন গবেষণা হয়েছে বলেও জানা নেই। হয়তো এর সংগে মোহাম্মদ তোয়াহার মত একজন বামপন্থী নেতার নাম যুক্ত আছে বলেই।
১৯৯৫ সালে জেলার আয়তন ছিল ৩৬০০ বর্গ কিলোমিটার, অথচ উপজেলা ছিল মাত্র ৬টি। হাতিয়া’র আয়তন ছিল ১৫০০ বর্গ কিলোমিটার আর সদর উপজেলা ১০০০ বর্গ কিলোমিটার। কোম্পানীগঞ্জ বাদ দিলে বাকি তিন মেইনল্যান্ড উপজেলা ছিল আয়তনে ছোট এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। অর্থাৎ এই জেলার ৩০০০ বর্গ কিলোমিটার ভূমি ছিল ভাঙ্গা গড়ার শিকার। যে কারণে ভূমি-স্বত্ব ও মালিকানা নিয়ে এই জেলায় শত বছরেরও বেশি সময় ধরে মামলা-মোকদ্দমা লেগে ছিল। বিশেষ করে প্রতি বছর ধান কাটা মৌসুম এলেই চরের ধান কাটা নিয়ে দাংগা হাংগামা ছিল সাধারণ ঘটনা। জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর জন্য প্রতি বছর এই চ্যালেঞ্জ উতরানো ছিল এক বড় অর্জন।
নোয়াখালী জেলার উত্তরের উপজেলাসমূহ, সেনবাগ, চাটখিল ও বেগমগঞ্জ ছিল ঘনবসতি পূর্ণ আর সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও হাতিয়াতে প্রচুর খাস জমি ছিল বন্দোবস্তের অপেক্ষায়। নোয়াখালী শহরের সম্পন্ন লোকেরা কেউ কেউ বেনামে ১০০০/২০০০ একর ভূমিহীনদের মাঝে বন্দোবস্তকৃত জমির মালিক। যে কারণে চরাঞ্চলের তহশীলগুলো ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। চরের তহশীলের তহশীলদাররা অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের কারণে ছিল প্রভাবশালী। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে এখানেই দিতে হবে প্রথম ঝাঁকি। একটা বড় সুবিধা ছিল যে আব্দুস সোবহান শিকদার, তারিকুল ইসলাম বা আমার কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল না এবং বিধি বহির্ভূত কোন কিছুর প্রতি পক্ষপাতও ছিল না। ফলে আমি তহশীলদার সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক মমিনউল্লা পাটওয়ারী এবং কামালউদ্দিন আহমেদকে ডাকলাম।
কামালউদ্দিন আহমেদ এর ভাই জামালউদ্দিন আহমেদ ১৯৭০ ব্যাচ এর ইপিসিএস কর্মকর্তা ছিলেন, তখন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এ কর্মরত। তাঁদের উভয়কে বললাম, যে সব তহশীলদারের এক স্টেশনে দুই বছর হয়েছে তাঁদের বদলী করবো। তাঁরা তাঁদের নিজেদের জন্য তিনটি করে পছন্দক্রম দিতে পারবেন। অন্য কারো বিষয়ে কোন কথা বলতে পারবেন না। তাই হল, তাঁরা তাঁদের পছন্দক্রম দিলেন আর আমি জুলাই মাসে প্রথম আদেশেই ২০ জন তহশীলদারকে বদলী করলাম। সৌভাগ্যক্রমে জেলা প্রশাসক আমার এই উদ্যোগে কোন আপত্তি করেননি। যদিও তাঁর বাসভবন থেকে সুপারিশ ছিল যা সম্মানের সংগে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এরপর যতদিন ছিলাম ততদিন এ বিষয়ে কোন সমস্যা পোহাতে হয় নাই। কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম কোন একজন জেলা প্রশাসক তদবীর ঠেকানোর জন্য লটারীর মাধ্যমে তহশীলদার বদলী করছেন। এটা একটা বিকল্প পদ্ধতি কিন্তু এখানে জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্ত নেবার অক্ষমতাই প্রতিফলিত হয়।
আমার চাঁদপুরে কর্মকালীন শিক্ষা ছিল পরিদর্শন, পরিদর্শন এবং পরিদর্শন। আমি তদনুযায়ী তহশীল পরিদর্শন শুরু করি এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিতেও শুরু করি। লক্ষ্য করলাম যে আমার পূর্ববর্তী এডিসিরা প্রতিমাসেই ভেজা তহশীল (চর এলাকায়) পরিদর্শন করলেও কোন কোন শুকনা তহশীল (উত্তরের তিন উপজেলায়) পাঁচ বছরেও পরিদর্শন করেন নাই। সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমার অবস্থানকালে আমি নোয়াখালী জেলার তৎকালীন ৬৫টি তহশীলের সবগুলো অন্ততঃ একবার পরিদর্শন করবো। পূর্ব শিক্ষা অনুযায়ী আমি পরিদর্শনকালেই পরিদর্শন নোট ডিকটেশন দিয়ে লিখিয়ে নিতাম ফলে অফিসে ফিরে আসার পর খসড়া চূড়ান্ত করা ছাড়া কাজ থাকতো না। সিডিএসপি প্রকল্পের সূত্রেও আমাকে প্রকল্প এলাকায় নিয়মিত দর্শন ও পরিদর্শনে যেতে হত।