জালাল আহমেদ
অনেক ম্যাজিস্ট্রেট মামলার তারিখ নির্ধারণে পেশকারের উপর নির্ভর করেন ॥ ম্যাজিস্ট্রেসী জীবনে আমি কখনো এ কাজটা করিনি

আদালতের কাজ আর অফিসের কাজের মধ্যে পার্থক্য অনেক। মূল পার্থক্য হল আপনি কাজ করছেন শতচক্ষুর সামনে এবং সবাই পার্টিও না। অনেকেই আছে শুধু আদালতকে দেখতে এসেছে, ধারণা তৈরী করতে এসেছে। এমন অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল বাঁশখালীর ইউএনও থাকাকালে। আমার সংগে কাজ করা উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট আজিমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর সুনাম এতখানি ছিল যে, শুনতে আতিশয্য মনে হবে, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ আসতো শুধু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে দেখার জন্য। ফলে সেই উচ্চাসনে উঠার জন্য, বসার জন্য যথাযথ প্রস্তুতি থাকাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৭ সালের ১লা নভেম্বরের আগে প্রশাসন ক্যাডারে আমার যে সব সহকর্মী নিয়মিত আদালতে বসতেন তাঁরা বিশেষ করে এই অনুভূতির সংগে পরিচিত। তবে যারা মহানগর আদালতে বসেননি তাঁদের পার্থক্যটা পুরোপুরি অনুধাবন করতে কিছুটা অসুবিধা হবে।
মহানগর আদালতগুলো কাজের চাপের জন্যই বেশি পরিচিত এবং এখানে একবার কাজ করে গেলে কাজের চাপের ভয় অনেকখানিই কেটে যায়। ফলে আমি সবসময়ই আদালতে বসার প্রস্তুতি নিতাম, মানসিক ও শারীরিক। মানসিক হল, ‘টু ফলো দ্য ডায়েরী’! আদালতের কেস ডায়েরী আমি নিয়ন্ত্রণ করতাম। সে সময়ে বা এই সময়েও অনেক ম্যাজিস্ট্রেট মামলার পরবর্তী তারিখ নির্ধারণে পেশকারের উপর নির্ভর করেন। আমি এই কাজটা আমার দশ বছরেরও বেশি পিউর ম্যাজিস্ট্রেসী জীবনে কখনো করিনি। কেস ডায়েরী টেবিলে খোলা থাকতো আর যে কোন মামলার পরবর্তী তারিখ ডায়েরী দেখে আমিই ঘোষণা করতাম। ফলে কোনদিন কোন মামলা থাকবে তা আমিই ঠিক করতে পারতাম, সহজ মামলা জটিল মামলা, কম সাক্ষী বেশি সাক্ষী, সপ্তাহের শুরু বা সপ্তাহের শেষ এভাবে ঠিক করা যেত। ফলে আমি আগে থেকেই জানতে পারতাম যে ঐদিন আমার সামনে কি আসছে। নিজে পড়ালেখা করে প্রস্তুতি নেয়া যেতো। আমার তো পড়ার অভ্যাস আছেই, তাতে তা’ সহায়তা করেছে।
আমি এর আগে রশিদ দারোগার কথা বলেছি। অনেক আইনজীবীও আছেন এমন যে বিভিন্ন আইনের ধারা আর ডিএলআর এর উদ্ধৃতি দিয়ে আদালতকে ঘাবড়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। আমি এর চমৎকার ফল পেয়েছিলাম, যখন আমিও ডিএলআর ধরে জবাব দিতে সমর্থ হলাম বিশেষ করে একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে সর্বশেষ কেস’ল উল্লেখ না করে পুরনো কেস’ল উল্লেখ করার কারণে লজ্জা দিলাম তারপর আইনজীবীরা অন্তত: আমার সংগে আর এ চেষ্টা করেননি। আদালতের পোষাক আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, আমি সবসময় আদালতের উপযোগী পোশাক পরার চেষ্টা করেছি, আরামদায়ক, দৃষ্টিকটু নয় এমন। “ন্যায় বিচার শুধু করলেই হয় না, ন্যায় বিচার যে করা হচ্ছে তা বুঝানোও গুরুত্বপূর্ণ”, এ বিষয়টা মাথায় রাখা, মানুষের মনে যেন এমন কোন ধারনা না জন্মায়। এটা যে কোন পাবলিক অফিস সম্পর্কেই সত্য। একজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি সকলের চোখের সামনে বাস করেন তাঁর একথা ভাবার কারণ নাই যে মানুষ তাঁকে অনুসরণ করছে না। তিনি যা বলেন বা করেন তাঁর সবকিছুই তিনি সাক্ষ্য রেখেই করছেন এবং সাক্ষীরা তা আলোচনা করেন। তাই আদালতের জন্য কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কার সংগে মেলামেশা করছে, কি বাজার করছে তার সবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে অন্য সরকারি কর্মকর্তার সামাজিক আচরণ আর বিচারকদের সামাজিক আচরণে অনেক পার্থক্য থাকার কথা। আগে থাকতোও সেটা যদিও এখন মিলে মিশে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রত্যেক এলাকার কিছু বিশেষত্ব থাকে এবং এটা কোর্টে বসলে বুঝাও যায় মামলা বা বিবাদের ধরণ দেখে। আমি এর আগে বাঁশখালীতে চারমাস কোর্ট করেছি উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতিতে। তখনো বিশেষ ধরনের অপরাধ প্রবণতা, বিরোধের বিষয় ও মানুষের ইন্টারেস্টিং নাম দেখেছি। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটান কোর্টেও এর ধারাবাহিকতা ছিল। তবে চট্টগ্রাম বন্দরনগরী ও ব্যবসা কেন্দ্র হওয়ায় বাণিজ্যিক বিরোধ নিয়ে মামলার সংখ্যা ছিল প্রচুর। আরা বন্দর থাকায় বন্দর থেকে চুরির অসংখ্য নন-জি আর মামলাও আসতো। শুল্ক আইনের ধারায় চোরাচালানের প্রচুর মামলা আসতো। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীরও বেশ কিছু মামলা আসতো। প্রথম দিকে আমাদের তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকায় মামলার চাপ ছিল অনেক বেশি। পরে আরো দুটি পদ সৃজন হলেও মামলাও সমানতালে বাড়তে থাকে। আমরা যারা অনেকদিন একসংগে কাজ করেছি তাঁদের মধ্যে ছিলাম ১৯৮১ ব্যাচের ওয়াহিদুন্নবী চৌধুরী, আমার ব্যাচমেট কওসার জহুরা, ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের মাহবুবুর রহমান, মাইনুদ্দিন খোন্দকার ও পরে সদ্য প্রয়াত শামসুল কিবরিয়া চৌধুরী।
ওয়াহিদুন্নবী চৌধুরী ছিলেন খুব সাবধানী ম্যাজিস্ট্রেট, তিনি এমনকি কোন কাগজপত্র সত্যায়ন করতেন না। কওসার জহুরা সাধারণ মামলায়ও জামিন দিতে পরান্মুখ ছিলেন। ফলে আমাদের উপর এসে চাপ পড়তো। বিভিন্ন সনদপত্র প্রত্যয়ন একটা বাড়তি ঝামেলা বলেই অনেকে মনে করতেন এবং সনদপত্র প্রত্যয়নের ঝামেলার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এটা একটা কুটিরশিল্প হিসাবে বিকশিত হয়েছিল। আমার অভ্যাস ছিল সহজে প্রত্যয়ন করা। এটা করতে গিয়েই একবার বিপদে পড়লাম। আমি সাধারণতঃ চেনা কেউ নিয়ে না আসলে ছবি প্রত্যয়ন করতাম না। একবার চান্দগাঁও এর এক আবদুল মালেকের ছবি প্রত্যয়ন করলাম, আমাদের এক পেশকার নিয়ে আসাতে এবং স্বাভাবিকভাবেই ভুলে গেলাম। এর মাস ছয়েক পর তলব আসলো অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএও) ১৯৭৯ ব্যাচের আবদুল আজিজ এর দপ্তর থেকে। আমার প্রত্যয়ন করা ছবি দিয়ে এক আবদুল মালেক হুকুম দখলকৃত জমির প্রবাসী মালিকের টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছে।
আমি গেলাম কোর্ট বিল্ডিং এর তিনতলায় তাঁর কক্ষে। এই কক্ষটা ছিল আমার দৃষ্টিতে চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং এর ‘বেস্ট ভিউ’ রুম, জানালা দিয়ে কর্ণফুলী পর্যন্ত চমৎকার দৃশ্য দেখা যেত। তদন্তে দেখা গেল যে আমি যার ছবি প্রত্যয়ন করেছি তাঁর নাম আসলেই আবদুল মালেক যদিও তিনি জমির মালিক আবদুল মালেক নন। আমি খুব অল্পের উপর এই ছোট্ট ফাড়া কাটিয়ে বের হয়ে এলাম এবং ভুলে গেলাম। ২০০০ সালে আমি যখন জ্বালানী বিভাগে সিনিয়র সহকারী সচিব তখন চট্টগ্রাম থেকে দুর্নীতি দমন ব্যুরো’র এক পরিদর্শক এলেন এই বিষয়ে পরবর্তীতে রুজুকৃত এক মামলায় আমার সাক্ষ্য নিতে। তখন বুঝতে পারলাম যে আবদুল মালেক এর নাম আবদুল মালেক না হয়ে অন্য কিছু হলে সদবিশ্বাসেকৃত আমার এই কাজেও আমার নাম আসামীর তালিকায় চলে যেতে পারতো! একেই বলে “এস্কেইপড ন্যারোলী”!