জালাল আহমেদ
‘তাঁকে’ উপজেলা চেয়ারম্যান এর রুম না হয়ে কোনদিন আদালতে যেতে দেখিনি
পরদিন সকালে বাঁশখালী উপজেলা চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি শিকদারের সংগে দেখা হল। তাঁর বাড়ি ছিল সদর জলদী ইউনিয়নে এবং তিনি আগে ছিলেন জলদী ইউনিয়ন পরিষদ এর চেয়ারম্যান। আমি যাবার কিছুদিন আগে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এর শূন্য পদে উপনির্বাচনে ইউপি চেয়ারম্যান থেকে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং এতে তাঁর কিছুটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সও ছিল। আমি নিজেও একটু সন্দিহান ছিলাম তাঁর সক্ষমতা নিয়ে (কয়েক বছর আগে তিনি মারা গিয়েছেন)। তবে আমাদের জেনারেশনের কর্মকর্তারা সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেছি উপজেলা পদ্ধতি চালু হবার পর এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সংগে কাজ করার মানসিক প্রস্তুতি আমাদের ছিল। তাঁর রুমেই দেখা হল ৮নং জলদী ইউনিয়নের নতুন চেয়ারম্যান আলী আকবর বহদ্দার এর সংগে, সাধারণ দৃষ্টিতে সহজ মানুষ।
১নং পুকুড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন মোস্তাকিমুল হায়দার চৌধুরী, জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করা, চাকসু সদস্য ছিলেন। জাকের আহমেদ চৌধুরী ছিলেন ২নং সাধনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। ৩নং খানখানাবাদ এর চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুল হামিদ যিনি খান বাহাদুর আব্দুস সাত্তার (চট্টগ্রাম শহরে তাঁর নামে কেবি আব্দুস সাত্তার রোড আছে) এর পরিবারের সদস্য। ৪নং বাহারছড়া ইউনিয়নে উপনির্বাচন হয় আমি যাবার পরেই, চেয়ারম্যান হন আহমদুর রহমান। ৫নং কালিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন মফজল আহমদ চৌধুরী। ৬নং বৈলছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন সোহাগ মিয়া। এটা তাঁর প্রচলিত নাম, তাঁর বাবা নুরুল ইসলাম এর আগে চেয়ারম্যান ছিলেন ৩২ বছর। তারও আগে তাঁর পিতা খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীও প্রায় ৩০ বছর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কাথারিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ৭নং সরল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন মাহমুদুল হক।
৯নং গন্ডমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। শীলকূপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন শামসুল ইসলাম। ১০নং চাম্বল ইউনিয়নের তরুন চেয়ারম্যানের নামও মনে পড়ছে না। ১১নং পুঁইছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন রেজাউল আজিম চৌধুরী, তার আগে চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর বড় ভাই রেজাউল করিম চৌধুরী। এই পরিবার থেকেই পালাক্রমে ঐ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হত। ১২নং ছনুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। শেখেরখীল ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান ছিলেন ফেরদৌস আহমেদ। ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০/১১ টিতেই স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী পরিবারসমূহ থেকে দীর্ঘদিন ধরে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আসছিল। বাঁশখালী এর অবস্থান এবং শিক্ষার নিম্নহারের কারণে একটা রক্ষনশীল এলাকা হিসেবে বিবেচিত হত। যে কারণে ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বের প্রতি এলাকার মানুষের আনুগত্যও ছিল।
আমি আমার অভ্যাস মত এসেই উপজেলা ঘুরে দেখতে শুরু করি। জুন মাসের মধ্যে জলকদর খালের পূর্বপাশে প্রায় পুরো উপজেলা ঘুরে দেখা হয়ে যায়। উপজেলার অভিজাত পরিবারগুলোর মধ্যে প্রাক্তন উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর পরিবার অন্যতম। তবে সামাজিকভাবে জলদী ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান শেখ মরতুজ আলী মিয়া’র পরিবার ছিল অগ্রগন্য। এছাড়া সাধনপুরেও একটি অভিজাত রায় পরিবারের বসবাস ছিল। এই উভয় পরিবার তাঁদের আভিজাত্যকে চট্টগ্রামে মুঘল আভিজাত্যের সঙ্গে তুলনা করতো। ১৬৬৬ সালে মুঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়, দোহাজারীতে সেনা গ্যারিসন স্থাপন এবং দোহাজারীকে রিয়ারে রেখে এই সব মুঘল আউটপোস্ট স্থাপিত হয়। রায় বাড়িতে আমি গিয়েছি, সেখানে ত্রিপুরার সংগে যুদ্ধে ত্রিপুরা থেকে নিয়ে আসা দশভুজা প্রতিমা ছিল। এছাড়া বানীগ্রাম-সাধনপুরে দুর্গা প্রতিমার গায়ের রঙ ছিল ভিন্ন।
শেখ মরতুজ আলী মিয়া’র বাড়ির চারপাশে ছিল গড় খাই (খাদ) বা পরিখা। সুজিত কান্তি শিকদার এর আগে মরতুজ আলী মিয়া ছিলেন ৩৩ বছর জলদী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। মাঝখানে ৬০ এর দশকের শেষ দিকে হারুনুর রশিদ চৌধুরী (হারুন কন্ট্রাক্টর) দু’বছরের জন্য চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রথম ইউএনও এজেএম সালাহউদ্দিন আহমেদ এলেন ঢাকা সদর (সাউথ) থেকে এই অজপাড়াগাঁয়ে। নিয়ম করলেন যে লুঙ্গী পরে কেউ তাঁর অফিস কক্ষে প্রবেশ করতে পারবে না। আর শেখ মরতুজ আলী মিয়া সারা জীবন পড়েছেন লুঙ্গী আর কাঁধে গামছা। আগে সাধারণতঃ বাঁশখালী থানায় নতুন সিও সাহেব বা ওসি সাহেব এলে মরতুজ আলী মিয়া’র সংগে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করতেন। উপজেলা যুগে তা’ হয়নি। নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ব্যর্থতা মরতুজ আলী মিয়া’র নির্বাচনী ব্যর্থতায় রূপান্তরিত হল।
একটা বিষয় আমি দ্রুতই বুঝতে পেরেছিলাম যে একজন ফিল্ড অফিসার এর বড় প্রয়োজন জনস্বার্থে নিয়মের ভেতরে থেকে দ্রুত সেবা দেয়া! আমি তাই চেষ্টা করতাম এবং নিশ্চিত করার চেষ্টা করতাম যে এটা মানুষ জানবে। এটা কঠিন পথ, আমি সবসময় কঠিন পথই অনুসরণ করেছি। শো অফ এর মাধ্যমে জনপ্রিয় হওয়া যায় কিন্তু সেটা ক্ষণস্থায়ী। আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে খুশি রেখে পদে থাকার চেষ্টা কখনো করিনি। কাজে যোগদান করার কিছুদিনের মধ্যে বাঁশখালী’র তৎকালীন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এলেন এক অবৈধ প্রস্তাব নিয়ে। আমি সরাসরি তাঁকে বললাম যে আমি এসবের মধ্যে নাই, শুধু এটা নিশ্চিত করবেন যে লোকজন জানবে আমি এর মাঝে নাই। আমি প্রায় ১৩ বছর বেইলী রোডে সরকারী বাসায় বাস করেছি, রমনা পার্কে হাঁটতে গিয়েছি। সেখানে ওই পিআইও সাহেবের সঙ্গে দেখা হত। তিনি তাঁর বিভাগে আরো উঁচু পদ থেকে অবসরে গিয়েছেন, তাঁকে দেখলেই আমার সে কথা মনে পড়তো।
পিআইও সাহেবের ওই অসঙ্গত প্রস্তাবের কারণে কি না জানি না, আমি অফিসিয়াল ফিল্ড ভিজিট শুরু করলাম কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির রাস্তা পরিদর্শনের মাধ্যমে। সকালবেলা উপজেলা চেয়ারম্যান তাঁর রুমে চা খেতে ডাকলেন। তাঁর চেম্বারের পাশে আরেকটা গোপনীয় চেম্বার ছিল। সেখানে বসালেন, চা খেলাম। কথাবার্তা যা বললেন তার মোদ্দা কথা কাজ টাজ যা করা হয়েছে তা বৃষ্টিতে অনাসৃষ্টি হয়েছে, ভেসে গেছে ফলে আমি বাস্তবে দেখলে ভুল ধারণা পোষন করতে পারি এই সব।
আমি আমার অফিস রুমে ফিরে আসার পর সহকারী জজ মাহবুবুল আলম আমার রুমে এলেন। তিনি চেয়ারম্যান এর রুমেই ছিলেন। একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হিসাবে তাঁর আচরণ ছিল ব্যতিক্রমী। তাঁকে উপজেলা চেয়ারম্যান এর রুম না হয়ে কোনদিন আদালতে যেতে দেখিনি আমি। তিনি আমাকে বুঝালেন যে সুজিত বাবু অনেক ভালো মানুষ, এমপি সাহেবের নিজের লোক, তাঁর সংগে বিরোধে জড়ানো ঠিক হবে না। আমি বললাম এটাতো কোন বিরোধ না, আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি। আমি একাধিক প্রকল্প এলাকা ভিজিট করলাম এবং এই প্রকল্প পরিদর্শন নিয়েই প্রথম থেকেই উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সম্ভবতঃ চেয়ারম্যানের কারণেই শুরু থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সংগেও দূরত্ব তৈরী হয়ে গেল। অন্ততঃ এই জিনিসটা স্পষ্ট হল যে পূর্ববর্তী ইউএনওরা যেমন কারো ইচ্ছাপূরণে কাজ করেননি, আমিও তা করবো না।