এমরানকে নিয়ে শোক গাঁথা
আব্দুল বাছিত চৌধুরী, সুইডেন থেকে

তারজালের বদৌলতে মুহূর্তেই ছড়িয়ে গেলো সংবাদটি ইথারে। থমকে গেলাম আমি। অতি শংকা, দ্বিধা ও সন্দেহের বশে টেলিফোন সংলাপ করে সংবাদটির সত্যতা জেনে নিলাম। এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে সংবাদটির মর্মকথা হজম করতে হলো। আমাদের অতি স্নেহের, অতি প্রিয় আমিনুর রশীদ এমরান আর বেঁচে নেই। সে ১৬ই ডিসেম্বর স্থানীয় সময় বেলা ১২টা ১মিনিটে মিশিগানের এক হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
এমরান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও গণমানুষের কল্যাণে ছিলো এক নির্ভীক নেতা ও সংগঠক। তার চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান ধারণায় সর্বক্ষণ বিরাজ করতো গভীর দেশপ্রেম। দেশের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার অসাধারণ আত্মত্যাগের কঠোর প্রত্যয়ে দীপ্ত। সে তার দলের প্রতিও ছিল উদার, অনুগত এবং কর্মকুশল। দল ক্ষমতাসীন থাকার সময়ে তার দুর্নীতিমুক্ত থাকার প্রচেষ্টা সুস্পষ্ট হয়েছে যা তার অনন্য যোগ্যতার সংযোজন।
স্বৈরশাসনের প্রারম্ভে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে ছাত্র আন্দোলনের সূচনা করি তার ধারাবাহিকতায় হবিগঞ্জে আন্দোলন-সংগঠনে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ আসে। সেই পরিস্থিতিতে সর্বকনিষ্ঠ তরুণ হিসেবে এমরানের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা এবং পরিচয়ের নৈকট্য। তার বন্ধু-বান্ধবরাও এক অভিন্ন প্রতিবাদী কন্ঠের একই বিপ্লবী সুরে বাঁধা। দেশের প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থা এবং বাস্তবিক মূল্যবোধের বিবর্তনে যখনই উজ্জ্বল সম্ভাবনার পরিচয় দিয়ে কোন মেধাবী তরুণ রাজনীতিতে আগ্রহী হয় তখন তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাতে আমি দ্বিধান্বিত হই, চিন্তাগ্রস্ত হই এমনকি মিশ্রিত মনোভাবের সংকটে নিপতিত হই।
কারণ রাজনীতির কুৎসিত প্রাঙ্গণে মেধাবীরা যেমনি অধিকাংশ উচ্ছৃঙ্খল, অভদ্র, অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিতদের কাছে অসহায়ের মতো কোণঠাসা হয়ে পড়বে তখন খারাপ লাগবে। তাছাড়া দেশে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে অর্জনের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তও আমাদের নেই। আমার ধারণা যে সচেতন অংশ যাই মনে করুক না কেন জনগণের একটি অংশ ভদ্রতা, সততা, দুর্নীতিমুক্ত, দেশপ্রেম ইত্যাদির ভাব-ভাষা-অভিব্যক্তি পরিমাপ করতে পারে না। তাইতো খোলা চোখে মেধাহীনদের বিকাশ এবং দুর্নীতিবাজদের মহাপ্লাবনে সারাদেশ আজ গভীর সংকটে। জাতীয় রাজনীতিতে বিভিন্ন সুযোগে নতুন নেতৃত্ব বিকাশে আমার ইতিবাচক মনোভাবের কারণে বহু নেতার রাজনীতিতে পদার্পণ সহজতর হয়েছে। রিজভী, ইলিয়াস, খোকন, অভি, মিলন, সালাহউদ্দিন, জাহিদ হোসেন চুন্নু, নাসিরুদ্দিন পিন্টু, আজম খান, সানাউল্লা সহ অনেক নেতা আমার সহযোগিতা পেয়েছে। আমরাও অনুরূপভাবে রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল ভাই, মেনন ভাই, কমরেড ফরহাদ, ওবায়েদ ভাই, ইনু ভাই, ফেরদৌস কোরেশী ভাই, সাইফুর ভাই, মান্না ভাই, আখতার ভাই, কাজি আরিফ ভাই, মাহবুবুল হক ভাই, মাহবুব জামান ভাই, মোশতাক ভাই, বিচারপতি জাকির আহমদ, বিচারপতি মিজবাহউদ্দিন, আল মুজাহিদী প্রমুখের সাহচর্য্য এবং সযতœ স্নেহ পেয়েছি। হবিগঞ্জে ভালো নেতৃত্বের বিকাশ ঘটুক- এই প্রত্যাশায় এমরানের প্রতি সবসময়ে আমার একটি সদিচ্ছা ও দুর্বলতা ছিল। তাই তার প্রতিটি কর্মোদ্দীপনায় আমার একটি সুপ্ত সমর্থন ছিল এবং প্রায়শঃই তাকে উৎসাহ দিতে পিছপা হতাম না। তাকে যথাসম্ভব সুপরামর্শ দিতাম। তদুপরি তার একজন অভিভাবক হিসেবে তার চলার পথ যাতে করে ঝুঁকিবিহীন থাকে সেটি নিশ্চিত করতাম। এমরানের ভাবনা ছিলো অনেক ক্ষেত্রেই সময়ের চেয়ে অগ্রসর এবং মানুষের জীবন-মান নিয়ে। প্রতিটি অঞ্চলের প্রতিটি সমস্যা তার অবগতিতে। মানুষের সাথে গভীরভাবে না মিশলে এবং ভালো না বাসলে এই গুণটি রপ্ত হয় না। আমি এমরানের এই গণমানুষের হৃদয়ঘনিষ্ঠ হওয়া এবং এর উত্তরণ নিজে দেখেছি। দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে তার চোখ-কান খোলা রাখা, অর্থবহ আলোচনা করা এবং আদর্শভিত্তিক আত্ম-উন্নয়নে তার মনোযোগ এবং প্রচেষ্টা লক্ষ্য করেছি। রাজনীতিতে অনেক ব্যক্তি আছেন দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু রাজনীতিকে দেয়ার মতো কিছু নেই। এমরান এই ধারার ব্যতিক্রম। সে সবসময়েই রাজনীতিকে, দলকে, তার পরিচিত পরিবেশকে অনেক কিছু দিয়ে গিয়েছে। তার স্মৃতিতে আমরা সবাই যে বড়ো কাতর। ক্রীড়াক্ষেত্রে তার বিচরণ ও অবদানকে উল্লেখ করা যায়। জেলার গন্ডি বা দেশের গন্ডি ছাড়িয়েও সে ছিল অনেকের কাছে সুপরিচিত। আমার মনে হয় যেসব রাজনীতিক রাজনীতি করে কিন্তু আদর্শের চর্চা করে না, রাজনৈতিক পড়ালেখার মধ্যে থাকে না সে অন্ধ এবং মৃত। এমরান ছিল ক্রমশঃ বিকাশমান একজন নেতা যার ছিলো রাজনৈতিক আদর্শ চর্চার নিরলস অনুশীলন। বই-পুস্তকের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো অটুট।
বহু রাজনীতিকের একটি সীমিত গন্ডি এবং সীমিত সম্পর্কের বিষয় দৃষ্ট হয়। সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক বড়ো রাজনীতিক তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলি সীমিত করে ফেলেন। কেউবা হয়ে যান অঞ্চলভিত্তিক নেতা। কিন্তু এমরান ছিলো এসবের পূর্ণ ব্যতিক্রম। অন্যান্য দল-মত-রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নেতা-কর্মীদের সাথে তার সুন্দর সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে অনন্য যোগ্যতা ছিলো তার। পারস্পরিক সৌহার্দ্য এবং আস্থা না থাকলে বেশী দূর এগুনো যায় না। মত-পথের অমিল থাকলেও যে এক টেবিলে বসা যাবে না এটা এমরানের নীতি ছিল না। এজন্যে সে প্রশংসার দাবিদার।
আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করি। কেউ কেউ কর্মীদেরকে উপরতলা থেকে, আবার কেউবা সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয় থেকে। এমরান ছিলো এমন একজন নেতা যে তার সহকর্মীদের সর্বোচ্চ স্তরে উদ্বুদ্ধ করতো এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে সকলেই সমানভাবে সক্রিয় থাকতো। এটা সুস্পষ্ট হতো যে তার সহকর্মীরা তাকে কতো ভালোবাসে। তার এই যোগাযোগের কুশলতা আমার চোখে এমরানের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট। কিভাবে সে অন্যের হৃদয়ে স্থান করে নিচ্ছে সেটিই হচ্ছে মূখ্য।
আমরা অনেক সময় অপছন্দের নেতার আদেশ পেয়ে এতো গায়ে মাখি না বা গরজ দেখাই না। বর্তমানে গণসংযোগের বিষয় রাজনীতি ও নির্বাচনে প্রাধান্য পাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গণসংযোগের কলা-কৌশল নির্ধারণে বিরাট বাজেট এবং বিপুল অংকের অর্থব্যয় হয়।
এমরান আমার মতে আরো বেশী বেদনাময়তার রেখাপাত করেছে এজন্যে যে সে সবসময়েই ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিতো। তার রেখে যাওয়া শিশুদের এবং বিধবা স্ত্রী সহ পরিবার-পরিজনের শোক-দুঃখ অনুধাবন করছি। তার এই মাঝবয়সে চিরবিদায়ে আমরা সকলেই খুব শোকাহত। জীবনের এই প্রান্তে, এই ক্রান্তিলগ্নে যখন শিশুরা অল্পবয়সী তখন পরিবারের কর্তার মৃত্যু যে কতো কষ্টের তা পরিবারই উপলব্ধি করবে। আমরা তাদের এই ব্যথা-বেদনার সহমর্মিতা এবং সমবেদনা প্রকাশ করি। দোয়া করি এমরানের অবর্তমানে যেনো শিশুরা উপযুক্ত পরিচর্যা পেয়ে মানুষের মতো মানুষ হয় এবং আমাদের সকলের মুখ উজ্জ্বল করে। তাহলে এমরানের বিদেহী আত্মাও শান্তি পাবে।
এমরানের সাথে দীর্ঘদিন নিয়মিত যোগাযোগ হয়নি। তার লেখালেখি চোখে পড়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি জানতে অনিচ্ছুক ছিলাম বিধায় যোগাযোগও শিথিল হয়ে পড়ে। এমরানের মৃত্যু গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামে এক অপূরণীয় ক্ষতি। ভোটাধিকার আদায়ের সংগ্রামেও তার অনুপস্থিতি শূন্যতা সৃষ্টি করবে। গণমানুষের সর্বপ্রকার মুক্তি এবং অধিকার আদায়ে অগ্রণী নেতা হিসেবে এমরানের অনুপস্থিতি একটি বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করবে। কেউ কেউ বলেন রাজনীতিতে নাকি কোন ব্যক্তিই অপরিহার্য্য নন এবং সকল শূন্যতা পূরণ হয়ে যায়। আমরা কিন্তু আর সুভাষ বসুকে ফিরে পাইনি। কেউ সুভাষ বসুর স্থানও পূরণ করেনি। আমার বিশ্বাস এমরানের স্বকিয়তা এবং অনন্য বৈশিষ্টের কারণে তার স্থানও অপূরণীয় থাকবে।
কবির ভাষায়,

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।

আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।