জালাল আহমেদ
জেলা প্রশাসকের সাথে নদীতে শিকারে বের হয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা
চাঁদপুর জেলা ইংরেজী ক্যাপিটাল ‘ডি’ অক্ষরের মত, এর খাড়া বাহুর পূর্বপাশে মতলব (এখন ছেংগারচর ও মতলব) চাঁদপুর সদর ও হাইমচর। পশ্চিমপাশে নদী, মেঘনা, জেলা শহরের উত্তর পশ্চিম থেকে পদ্মা এসে মিশেছে। অন্য উপজেলাগুলো, হাজিগঞ্জ, ফরিদ্গঞ্জ, কচুয়া ও শাহরাস্তি পূর্বপাশে। পশ্চিমে নদীর ওপারে মুন্সিগঞ্জ, শরিয়তপুর ও বরিশাল জেলা। এই তিন জেলার সংগেই চর নিয়ে এবং চরের সীমানা নিয়ে বিবাদ বিসংবাদ লেগেই থাকে। বিশেষ করে ধান কাটার মৌসুমে এটা বেড়ে যায়। তেমনি এক চর হল মিয়ার চর, বরিশালের সীমানায়, সেখানে হাইমচর এর সঙ্গে সীমানা বিরোধ এবং জমিতে পাকা ধান। নিষ্পত্তি না হলে এমন বিরোধ অনায়াসে খুনখারাবী পর্যন্ত গড়ায়। যারা চাষ করে তারা সাধারণ ভূমিহীন কৃষক, যারা তাদের পেছনে থাকে তাদের কাছে এই চাষীদের জীবনের কোন দাম নেই বরঞ্চ কোন প্রাণহানী হলে তা মামলার কাজে লাগে। সিদ্ধান্ত হল যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সহ আমি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারীগণ ঘটনাস্থলে গিয়ে ম্যাপ মিলিয়ে মেপে সীমানা ঠিক করে ধান কাটার ব্যবস্থা করে দেব। বরিশাল থেকেও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও অন্যরা আসবেন।
আমরা আমাদের পুলের লঞ্চ গভর্ণমেন্ট মোটর ভেসেল (জিএমভি) মাইজদী নিয়ে ভোর বেলায় হাইমচর ঘাটে উপস্থিত হলাম। সেখান থেকে ইউএনও হাইমচর, উপজেলা চেয়ারম্যান কায়কোবাদ সরকার, নীলকমল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তফা মিয়া সরকার, কানুনগো সার্ভেয়ারসহ অন্যদের তুলে অন্যপারে মিয়ার চরে গেলাম। ঐখানে বরিশালের কর্মকর্তারাও হাজির। শুরু হল ম্যাপ নকশা নিয়ে সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ। চরের অন্যতম সমস্যা হল যে ল্যান্ডমার্ক থাকে না, ফলে মাপজোক এর বেস পয়েন্ট নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে যায়। আমরা কাগজে, ম্যাপে, সরেজমিনে চরে হেঁটে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছি। এদিকে চরেরই একপাশে দুপুরের খাবার রান্না হচ্ছে। একপর্যায়ে এসে আমার মনে হল বাস্তবে পুরো চরই বরিশালের সীমানায় পড়েছে। আমি আমার এডিসি স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করলাম যে আমাদের জেলার যারা এখানে চাষ করেছে তাদের স্বার্থ তো রক্ষা করতে হবে। তখন এডিসি বরিশালের সঙ্গে স্যার কথা বললেন, চরের উত্তরে একটা নারিকেল গাছ ও দক্ষিণে একটা বাড়িকে ল্যান্ডমার্ক ধরে চরকে পূবে-পশ্চিমে দুই ভাগ করে ফেললাম।
সিদ্ধান্ত হল যে জমি চাষ করেছে সে বিধি অনুযায়ী সরকারি রাজস্ব পরিশোধ করে তার ধান কেটে নিতে পারবে, উভয়পক্ষ এতে সম্মত হয়। তখনকার ভূমি ম্যানুয়াল অনুযায়ী একর প্রতি ক্ষতিপুরণ ছিল ৩০০ টাকা। আমি কানুনগো হাইমচরকে তদনুযায়ী কাজ করার নির্দেশ দিলাম, এতে চাষীদের তালিকা করারও প্রয়োজন হবে যেখানে বরিশালের চাষীও থাকতে পারে। তারপর বসলাম দ্বিপক্ষীয় সিদ্ধান্ত লিখতে। অন্যরা খেতে বসলেন কিন্তু আমাদের ৫টা বাজলো লেখালেখি শেষ করতে। লিখার পর উভয়পক্ষের সই-সাবুদ নিয়ে বিনিময় করা হল। বেলা পড়ে আসতে থাকায় লঞ্চ ছেড়ে দেয়া হলে লঞ্চে বসে আলো জ্বালিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। হাইমচরের লোকজনকে হাইমচরে নামিয়ে আমাদের ফিরতে রাত ১০টা বাজলো। পরে শুনেছি যে বরিশাল এর পক্ষে ভূমি ম্যানুয়াল অনুযায়ী টাকার পরিবর্তে ফসল নেবার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ ফসলের হেফাজতের দায়িত্বে ছিল স্থানীয় চেয়ারম্যান। পরবর্তীতে এ নিয়ে অনেক অভিযোগ এর উদ্ভব হয় এবং তৎকালীন এডিসি (রাজস্ব) বরিশাল ও তার সহকর্মীগণ অনেক ঝামেলা পোহান।
ফিরে শুনলাম জেলা প্রশাসক কুমিল্লা আব্দুস সালাম সাহেব এসেছেন, শিকারে যাবেন নদীতে। আমাকে সঙ্গে যেতে হবে গাইড হিসেবে। পরদিন পানি উন্নয়ন বোর্ড এর একটা ভাল বোট নিয়ে আমরা বের হলাম অন্ধকার থাকতে। মেঘনা ধরে ভাটির দিকে গেলাম নদীর পশ্চিমপাড়ে কারণ সব চর ওপারের দিকেই। দুপুরের দিকে আমাদের বোট গেল নষ্ট হয়ে। বোট চালক তার সর্ববিদ্যা দিয়েও আর বোট চালু করতে পারলো না। তখন বাজে প্রায় দুটো। লোকজন বা নৌকা চোখে পড়লে জিজ্ঞেস করলাম এটা কোন চর? বলে মিয়ার চর, মানে গতকালের সেই চর যেখানে আমাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশনে সিদ্ধান্ত আমাদের অনুকূলে হয়েছে, কোন জেলা, বলে বরিশাল। ফলে পরিচয়ও দেয়া যাবে না। আরো কিছু পূর্বদিকে আসার পর একজন বললো জেলা চাঁদপুর, তখন পরিচয় দিলাম। এক জেলে নৌকা বেঁধে দুপুরের রান্না বসিয়েছিল তাঁকে অনুরোধ করলাম যে আমাদের পৌঁছে দাও হাইমচর। তার নৌকায় মাছ পরিবহনের জন্য বরফ রাখা, তাও নষ্ট হবে, তাকে বরফের দাম দেবারও প্রতিশ্রুতি দিলাম। তার চুলা গুটিয়ে নৌকায় তুললো, আমাদের বোট বাঁধলো তার নৌকার সঙ্গে তারপর বদর বদর বলে মেঘনা পাড়ি।
শুকনো খাবার সঙ্গে যা ছিল দুপুরে তাই তিনজন ভাগাভাগি করে খেলাম। এদিকে ভাটা লেগেছে, ঐ এক মাল্লার ছোট নৌকার পক্ষে বোট টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। নৌকা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে ভাটিতে আর অবাক কান্ড যে সেই ১০ মাইলের মেঘনায় কোন নৌকা বা অন্য বোট চোখে পড়ছে না। আমাদের অবধারিত গন্তব্য কি বঙ্গোপসাগর! কিছুক্ষণ পর চোখে পড়লো একটা ট্রলার পশ্চিম থেকে পূবে, রায়পুরের দিকে যাচ্ছে। আমরা ঘাড়ের গামছা তুলে নাড়াতে থাকলাম, তারা আমাদের দিকে কিছু এগিয়ে এলো। নৌকার উপরে বিছানো অন্ততঃ ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র, তারাতো আর কাছে আসে না, পরিচয় দিলাম, জেলা প্রশাসক কুমিল্লার পরিচয় দিলাম একটু বিশ্বাস করে কাছে এলো। আরো কথা বলে আরো কাছে, তারপর আমরা বোট তাঁদের ট্রলারের সঙ্গে বাঁধলাম। পরে দেখলাম যে তারা আসলে বরযাত্রী দল, যাচ্ছে রায়পুরে, তাই অস্ত্র দেখে কাছে আসতে ভয় পাচ্ছিল। তারা রাজি হল আমাদের হাইমচর ঘাটে পৌঁছে দিতে। তখনো জানি না যে দিনের দুর্গতি শেষ হলেও রাত তখনো বাকী।