জালাল আহমেদ
সরকারী গুদাম ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যক্তিগত গুদাম হিসাবে

১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে হত্যার পর ‘বাদি’ গ্রুপ বা প্রীতি চাকমা’র গ্রুপের অধিকাংশ সদস্য আত্মসমর্পণ করে। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা’র নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনীর বড় অংশ রয়ে যায় শান্তি প্রক্রিয়ার বাইরে। ১৯৮৫ সালের ২১ অক্টোবর পানছড়ি সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে চেংগী ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে সেনাবাহিনীর সংগে শান্তিবাহিনীর শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনায় বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষে ছিলেন চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল মালেক। দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা চলে, তারা সবাই দুপুরে খাওয়া দাওয়াও একসঙ্গে করেন। আমরা সবাই উৎকণ্ঠা ভরা একটা দিন কাটাই। ঐ আলোচনা ছিল একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শুরু যা ১৯৯৭ সালে এসে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি লাভ করে।
ইতোমধ্যে পানছড়িতে ইউএনও কোয়ার্টারের নির্মাণ কাজ শুরু হলো পুরনো টিনশেড বাংলো ভেঙ্গে। আমরা শিফট করলাম পেছনে নন-গেজেটেড কোয়ার্টারে। নীচতলায় একপাশে ব্যাটালিয়ন ২ আইসি মেজর শাহজাহান আরেকপাশে ইউএনও আর দোতলায় একপাশে আমি, অন্যপাশে উপজেলা চেয়ারম্যান রাজকুমার চাকমা। এদের মধ্যে একমাত্র আমিই একা থাকি, ফলে তরকারির বাটি সব বাসা থেকেই আসতে থাকতো আর শিকারের ভাগও ধারাবাহিকভাবে সব বাসাতেই যেত। এরমাঝেই সাহসী সহকারী কমিশনার নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বিয়ে করে ফেললো, মাইজভান্ডার দরবার শরীফের কোন এক পরিবারে এবং পানছড়ির মত জায়গায় সে বউসহ হাজির। পরে যখন সে লক্ষিছড়িতে সহকারী কমিশনার, ভাবিকে নিয়ে সেখানে যাবারও সাহস দেখিয়েছে। সেই নাজিম চৌধুরীই একবার বর্ষাকালে নৌকাযোগে পানছড়ি থেকে খাগড়াছড়ি যাচ্ছিল, নৌপথ আমি বলেছিলাম যে নিরাপদ নয়, মাঝপথে ঠিক ঠিক শান্তিবাহিনী নৌকা আটকালো, নাজিমকে দেখেই নাকি নাজিম এর সাইজ দেখে তাঁদের সন্দেহ হল। তাঁর সাইজও ছিল মাশাল্লাহ, উচ্চতা ৫’১১” আর মানানসই ওজনদার। জিজ্ঞাসায় সে বললো ইউএনও অফিসে কাজ করে। তাঁকে ইউএনও অফিসের কেরানী মেনে নিতে শান্তিবাহিনী’র কষ্টই হয়েছিল। শান্তিবাহিনী’র চেকপোস্ট পার হয়ে সে নৌকা থেকে নেমে যায় আর বাকি পথ কাঁদা মাড়িয়ে হেঁটে মেরে দেয়!
সিও ১৯ ইস্টবেঙ্গল এর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল এক ইন্টেলিজেন্স হাবিলদার, সামাদ, সে জীপের পেছনে বসে থাকতো। সিও সাহেব বলতেন যে পথে কোথাও জীপ গর্তে পরে গেলে সামাদ একাই এক পাশ তুলে ফেলতে পারতো। অনেক সময় কাঁধে কম্বল রেখে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি তুলে ফেলতো। সামাদের সঙ্গে আমারো পরিচয় হয়ে যায় তথ্য আদান প্রদান করতে গিয়ে। একদিন আমি বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম এর স্বাধীনতা একাত্তর বইটা পড়ছিলাম, সামাদ বসা সিঁড়িতে। সে জিজ্ঞেস করলো যে স্যার, কি বই পড়ছেন। আমি বললাম যে কাদের সিদ্দিকী’র মুক্তিযুদ্ধের বই। সে বলে স্যার আমি তো কাদেরীয়া বাহিনীর লোক। দেখেনতো আমার কথা কিছু লিখছে কি-না? সে তখন ওই বাহিনীতে তার পরিচয় দিল। আমি তো এর মাঝেই পড়েছি, খুঁজে বের করলাম। কাদের সিদ্দিকী’র সঙ্গে তার দেখা এক ক্যাম্প দরবারে, যখন জানতে চাওয়া হল যে কারো কোন সমস্যা আছে কি না, সামাদ দাঁড়ালো। কি সমস্যা? সে যথেষ্ট খাবার পাচ্ছে না। ক্যাম্প ইনচার্জ বললো যে তার রুটি লাগে ২০টা, এটা দেওয়া তো সম্ভব না। তার কি যোগ্যতা আছে জিজ্ঞেস করলে সে উঠে গিয়ে দরবারের সামনে দুই বছর বয়সী একটা গর্জন গাছের চারা বুকে জড়িয়ে ধরে তুলে ফেললো। কাদের সিদ্দিকী বললো যে ঠিক আছে, তুমি এখন থেকে আমার সংগেই থাকবে! বিখ্যাত জাহাজমারার ঘটনায় কাদের সিদ্দিকী লিখেছিলেন “সামাদ গামা রান্নাঘরে (জাহাজের) ঢুকে দেখতে পেল বড় বড় ডেকচিতে রান্না করা লোভনীয় প্রচুর খাবার। —-সামাদ গামা রান্নাঘরে ঢুকে, সব ভুলে, মুরগীর মাংস খাওয়া শুরু করে দিল। এক কোম্পানী হানাদারদের জন্য তৈরী মাংসের প্রায় বার আনা খেয়ে, আধঘন্টা পর সে বেরিয়ে এল”। আমার পাঠ শুনে সামাদ গামা কাঁদতে লাগলো যে কাদের সিদ্দিকী তাঁকে এই ভাবে উল্লেখ করেছে। তার কিশোর ছেলে সোহেল গামা তখনই দৈনিক ১২টা ডিম খেত। সামাদ গামা’র সঙ্গে এই সাক্ষাতও আমার সবসময় মনে পড়ে।
সিও ১৯ ইস্টবেঙ্গল লেঃ কর্ণেল মাহমুদ মতিন মোহাম্মদ কায়সার বদলি হলেন, নতুন সিও আসলেন লেঃ কর্ণেল ইসমত আহমদ চৌধুরী বীরপ্রতিক। ইউনিট অফিসারদের দেয়া ফেয়ারওয়েলে আমি একমাত্র সিভিলিয়ান। ঐদিন লেঃ কর্ণেল কায়সার এর বলা দু’টি কথা মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন যে ‘আপনার মেমোরী ভালো হতে পারে, সব মনে রাখতে পারেন, তবুও ডোন্ট ট্যাক্স ইয়োর ব্রেইন, টেক নোট, কখনো স্লিপ প্যাড ছাড়া সিনিয়রের রুমে যাবেন না’। একটা অনুসরণযোগ্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ। আর যখন কোন নিম্নপদস্থ কাউকে কোন ফরমায়েশ দেবেন তখন তার কাছ থেকে আবার শুনে নেবেন, ফরমায়েশটা সে বুঝেছে কি না! এতে অনেক ঝামেলা কমে যায়। কম্যুনিকেশন বা যোগাযোগ এখনো আমাদের একটা দুর্বল জায়গা।
পানছড়ি থাকাকালেই বড় ধরণের একটা অনিয়মের সঙ্গে পরিচয় হয়। পানছড়িতে অন্য অনেক জায়গার মতই খাদ্য গুদাম ছিল, ৫০০ টন করে দুটো গুদাম ছিল পাশাপাশি। খাদ্য সংগ্রহ অভিযান চলছিল, আমার উপর দায়িত্ব আসলো গুদামে মজুদ পরীক্ষা করে দেখতে। মজুদ দেখতে গিয়ে দেখলাম যে রেকর্ডে যে মজুদ আছে বাস্তব মজুদ তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। ঘটনা হল প্যাসিফিকেশন প্রোগ্রাম বা শান্তকরণ কর্মসূচী যে সকল কাজে খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার কাগজতো বিক্রি করেছেনই কিন্তু ক্রেতারা গুদাম থেকে খাদ্যদ্রব্য বেরও করেননি। সরকারী গুদাম ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যক্তিগত গুদাম হিসাবে। এই অনিয়ম আমি অবশ্য পরেও দেখেছি।