মাধবপুরের ত্রাস উজ্জল বাহিনীর বিরুদ্ধে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারের কাছে এলাকাবাসীর অভিযোগ
নিহতের শরীরে যেখানে কোন আঘাতের চিহ্ন নেই সেখানে তাকে নাকি ১৯ জন আঘাত করেছে
স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাষ্টু পাঠান (৩৫)। একজন প্রতিবন্ধী। মাধবপুর উপজেলার পৌর এলাকার পূর্ব মাধবপুরের গুণি মিয়ার ছেলে। ৮ ছেলের মাঝে রাষ্টু প্রতিবন্ধী হওয়ায় দুঃখের সীমা ছিল না তার পরিবারের। গুণি মিয়ার ছেলে উজ্জল মিয়া পাঠান এলাকায় মাদক ও দাদন ব্যবসা অপরাধ জগতের সিন্ডিকেট গড়ে তোলে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তার এই বাহিনীর অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে এলাকাবাসী যখন আন্দোলন শুরু করে তখন সুযোগ বুঝে উজ্জল মিয়া পাঠান নিজেরাই রাষ্টু মিয়াকে হত্যা করে প্রতিপক্ষের নামে খুনের মামলা দিয়ে নিজের আধিপত্য নিশ্চিত করে। এ ব্যাপারে প্রতিকার চেয়ে পূর্ব মাধবপুর, মুরাদপুর, হরিশামা, সুন্দাদিন ও পান পাড়া এলাকার লোকজন হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করেছেন।
আবেদনে উল্লেখ করা হয়, মাধবপুরে মুর্তিমান আতংকের নাম উজ্জ্বল বাহিনী। চুরি, ছিনতাই, মাদক, দাদন ব্যবসা, নারী নির্য়াতন ও দখলবাজীসহ এহেন কাজ নেই যা এ বাহিনী করে না। তাদের ভয়ে কয়েক গ্রামের সাধারণ লোকজন তটস্থ থাকে। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাদের উপর নেমে আসে অত্যাচার ও নির্যাতন। মিথ্যা মামলা দিয়ে করা হয় হয়রানী। অনৈতিক কাজ করে শূন্য থেকে অল্প দিনেই কোটিপতি বনে গেছে উজ্জ্বল বাহিনীর প্রধান উজ্জ্বল। চুরি, ডাকাতি, মাদক, নারী নির্যাতন ও খুনসহ ডজনখানেক মামলা ও সাধারণ ডায়েরী মাথায় থাকলেও এসবের তোয়াক্কা না করে বীরদর্পে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে সে। এলাকায় শত শত মানুষ তার দাদন ব্যবসার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে।
১৪ অক্টোবর সন্ধ্যারাতে উজ্জ্বল বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে কয়েকটি গ্রামের হাজারো জনতা জড়ো হয়ে প্রতিবাদ সভা করে। সভা শেষে বাড়ি ফেরার পথে প্রতিবাদী লোকজনের উপর উজ্জ্বল বাহিনী হামলা করে। খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি শান্ত করে। এরই মধ্যে উজ্জ্বলের প্রতিবন্ধী ভাই রাষ্টু মিয়া নিজবাড়িতে রহস্যজনক খুন হয়। প্রতিবাদকারীদের ফাঁসাতে রাষ্টু খুনের দায় চাপানো হয় জনসাধারণের উপর। তাদের নামে দায়ের করা হয় হত্যা মামলা। মামলা দায়েরের ফলে কয়েক গ্রামের সাধারণ মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের অত্যাচার ও মিথ্যা মামলার ফাঁদ থেকে বাচঁতে আন্দিউড়া ও বহরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ কয়েকশত মানুষ স্বাক্ষরিত একটি আবেদন দিয়েছেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি ও হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারের কাছে। আবেদনে স্বাক্ষরকারীরা রাষ্টু হত্যার সুষ্টু ও নিরেপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন। ঘটনার পর পরই উজ্জ্বল বাহিনী মোটরসাইকেল নিয়ে স্বশস্ত্র মহড়া দেয়া শুরু করে। এতে এলাকার নারী ও শিশুরা ভয়ে আতংকে আছে।
সরজমিনে পূর্ব মাধবপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোন পুরুষ লোক নেই। নারী ও শিশুরা দলবদ্ধভাবে বাড়িতে সময় কাটাচ্ছে আতংকের মাঝে। হত্যা মামলার আসামী আনোয়ার আলীর স্ত্রী রেজিয়া বেগমের সাথে কথা হয়। তিনি জানান, রাষ্টু মিয়া খুন হয়েছে নিজ বাড়িতে। তার গলায় কাটা চিহ্ণ। পুলিশ তাদের ঘরের ভিতর থেকে লাশ উদ্ধার করেছে। অথচ মামলায় চার্জের আসামী করা হয়েছে ১৯জনকে। ৪৪ জনের নামে হত্যা মামলার পর গং রাখা হয়েছে আরও ১০০ জনের নাম। এই গং এর ভয়ে কোন পুরুষ লোক এলাকায় থাকছে না। একজন প্রতিবন্ধীকে কিভাবে ১৯জন আঘাত করে। আর শরীরের কোথাও আঘাতের কোন চিহ্ন নেই কেন।
তিনি আরও জানান, পুরুষ লোকজন বাড়িতে না থাকায় তারা শিশু ও নারীরা রাতের বেলা কয়েক ঘরের মানুষ এক ঘরে গিয়ে রাত কাটান। আর রাতের বেলা ফাকা ঘরে এসে লুটপাট করে উজ্জল বাহিনীর লোকজন। দিনের বেলাও কেউ বাড়ি থেকে রাস্তায় যেতে সাহস পায় না উজ্জল বাহিনীর ভয়ে।
ওই বাড়িতে থাকা কয়েকজন ছাত্রী জানায়, উজ্জল বাহিনীর ভয়ে এলাকার স্কুল ও কলেজে যাতায়াতকারী ছাত্রীরা একা চলাফেরা করতে পারত না। তারা ছাত্রীদের ওড়নাতে টান দেয়াসহ ইভটিজিং করত।
এলাকাবাসী আরও জানান, মাধবপুর-শাহপুর সড়কের ব্রীজের নিচে উজ্জল বাহিনীর লোক রাতের বেলা বসে থাকে। ওই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী লোকজন প্রায়ই তাদের হাতে ছিনতাইয়ের শিকার হয়। এনজিওর কর্মীরা কিস্তির টাকা আদায় করে এই রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতে পারে না। কয়েক বছর আগের উজ্জল পাঠানদের সামান্য ভিটে বাড়ি ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। এখন তার হাতে কোটি কোটি টাকা, অগাধ সম্পদের মালিক। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১৩ সালে মাধবপুর পৌরসভার মেয়রসহ কয়েকটি গ্রামের কয়েক শতাধিক মানুষ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
ডিআইজি ও পুলিশ সুপার বরাবর এলাকাবাসীর আবেদনের বিষয়টি তদন্ত করছেন হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা। তিনি বলেন, হত্যা মামলায় যেভাবে আসামী দেয়া হয়েছে হত্যাকান্ডের নমুনায় তার ভিন্নতা পাওয়া যায়। কারণ আক্রমণ করে হত্যা করলে ভিকটিমের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত থাকার কথা। কিন্তু এখানে শুধু গলায় কাটা পাওয়া গেছে। তাও এলোপাতাড়ি নয়। আশা করছি তদন্তে প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হবে।
এ ব্যাপারে রাষ্টু পাঠানের ভাই ও হত্যা মামলার বাদী উজ্জল পাঠান বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার ভাই রাষ্টু প্রতিবন্ধী ছিল না, সে ছিল একজন ব্যবসায়ী। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মূলত গত মাসে পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের উপ-নির্বাচনে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে বিরোধের কারণে প্রতিপক্ষ আমার ভাইকে হত্যা করে। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তাতে যে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর এর কথা বলা হয়েছে তাও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে করা হয়েছে। হত্যা মামলার ঘটনা সম্পূর্ণ সঠিক এবং মাধবপুর থানা পুলিশ ৪ আসামীকে গ্রেফতার করেছে।