জালাল আহমেদ
শান্তিবাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মাঝে বিবাদ ও খন্ডযুদ্ধে লিপ্ত হতো আবার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষও চলতো
সাত নভেম্বর ১৯৮৩ তারিখে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালেই আমি পথ এগিয়ে মাটিরাঙ্গা থাকবো বলে রওয়ানা দেই। ইউএনও মাটিরাঙ্গা তাঁর গাড়ি আমার জন্য রেখে মানিকছড়ির ইউএনও এর সাথে চলে গিয়েছিলেন। সিএমএলএ’র সফর উপলক্ষে রুট প্রটেকশন সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত থাকার কথা আগেই জানানো হয়েছিল যাতে রাতে না থেকে সবাই নিরাপদে ফিরে যেতে পারে। জুরিন্দা ফেরীতে লম্বা লাইন থাকায় চেংগী পার হতে অনেক সময় লেগে গেলো। রাত ৮টার দিকে আমি মাটিরাঙ্গা পৌঁছাই। ডাকবাংলোতে আমাকে ভুল রুম খুলে দেয়া হয় আর বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় অন্ধকারে ইউএনও সাহেবের সঙ্গে গিয়ে যোগাযোগ করতেও ইচ্ছে হলো না। একটি অনুপযুক্ত বিছানায় ছিদ্রযুক্ত মশারীর ভেতরে অসংখ্য মশার সংগে শুয়ে রাত কাটালাম। মাটিরাঙ্গায় তখন সেটলার্সদের জন্য কাজ করছেন মাটিরাঙ্গা জোনের পুনর্বাসন ম্যাজিস্ট্রেট ১৯৭৯ ব্যাচের ড. জাফর আহমেদ চৌধুরী। তিনি জানতেন যে আমি আসবো এবং আমার নির্দিষ্ট রুমের চাবি তাঁর কাছে ছিল। পরদিন সকালে চট্টগ্রাম পৌঁছে শহরে ঢোকার মুখে মুরাদপুরে আমিন জুট মিলসে যাই। সেখানে মাপ ও পরিমাণ মতো কার্পেট ও ম্যাটের অর্ডার দেই। বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসারদের জন্য ম্যাট/কার্পেট এবং অন্য স্টেশনারিজ এর প্রাপ্যতা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সার্কুলার দিয়ে ঠিক করে দেয়। মাপমতো কার্পেট ম্যাট কাটা সেলাই ও জোড়া লাগানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বিধায় একদিন পর সরবরাহ নেব বলে ঠিক হয়।
চট্টগ্রাম শহরের পারসিভিল হিলে আমার এক খালু থাকতেন। চট্টগ্রাম কলেজে তিনি কেমিস্ট্রি পড়াতেন, তাঁর বাসায় গিয়ে উঠলাম। বিকেলে নিউমার্কেটে পর্দার অর্ডার দেই, জলসা ভবনে কারেন্ট বুক সেন্টার এবং স্টেশনে রেলওয়ে বুক স্টল থেকে বেশ কিছু বইও কিনি। কারেন্ট বুক সেন্টারের সংগে আমার এই সম্পর্ক এখনো অটুট। পরদিন নিউমার্কেট থেকে পর্দা সংগ্রহ করি। ১০ তারিখ সকালে যাই আমিন জুট মিলে, ফরমায়েশ মতো কার্পেট ম্যাট সংগ্রহ করতে একটু সময় লাগে। দুপুরের দিকে রওয়ানা দেই খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্য। হাটহাজারী-নাজিরহাট-বিবিরহাট পার হতে হতে শীতের বেলা গড়িয়ে যেতে থাকে। মানিকছড়ি উপজেলার আগে তিনটেহরী নামে একটা বাজার আছে, সে বাজার পার হয়ে গাড়ির একটা চাকা পাংচার হয়। চাকা পরিবর্তনে কিছু সময় লাগে আর বেলা পড়ে আসতে থাকে। মাটিরাঙ্গা যখন পার হই তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। ৭ তারিখ রাতের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে আর থাকতে মন চাইলো না ভাবলাম যে এক ঘন্টায় পৌঁছে যাব। সেটা ছিল একটা ভুল সিদ্ধান্ত যা পরে বুঝতে পারি। ঐদিন সূর্যাস্ত ছিল ৫ঃ১৫ তে আর রাতটা ছিল শুক্লা চতুর্দশী। আলুটিলার কাছাকাছি পৌঁছাতে দূষনমুক্ত আকাশ ভরা এক বিশাল চাঁদ উঠলো! তিন মাইল চড়াই বেয়ে যখন সবচেয়ে উঁচু জায়গায় পৌঁছেছি, যারপর ৩০০ মিটার এর মতো সমতল রাস্তা, তখনই পেছনের আরেকটি চাকা পাংচার হলো। তখন সময় অনুমান ৭ঃ৩০ টা, শীতের পাহাড়ী রাত, সঙ্গে আর স্পেয়ার চাকা নেই। আর ২০২০ এ বোঝানো যাবেনা ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর কেমন ছিল!
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্তিবাহিনীর উপস্থিতি এবং তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে আমরা জানি। তার অবসান হয় ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির মাধমে। ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করেন এবং জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা হিসেবে শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬-৮০ সালে শান্তিবাহিনী অত্যন্ত একটিভ ছিল এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অনেক খন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সরবরাহের উপর হামলা করে, টহল দলের উপর হামলা করে এবং কোথাও কোথাও সেনাক্যাম্পেও হামলা করে। মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা আইনে স্নাতক হলেও দিঘীনালা স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে জীবন শুরু করেন। নানিয়ারচর এলাকায় তাঁর পৈত্রিক বসতভিটা কাপ্তাই লেকের পানিতে ডুবে গেলে তাঁরা সপরিবারে পানছড়ি উপজেলার বাসিন্দা হন। তাঁর ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমাও শিক্ষকতা দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি শান্তিবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার এর দায়িত্ব গ্রহন করেন। এ কারণে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা ও পানছড়ি উপজেলা শান্তিবাহিনীর ‘হট বেড’ ছিল।
সামরিক বাহিনীর সঙ্গে শান্তিবাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হলে জেনারেল জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি সেটলার্স পাঠানো শুরু করেন এবং জেনারেল এরশাদ তা অব্যাহত রাখেন। এর প্রয়োজন ছিল কি না এ নিয়ে মতানৈক্য আছে এবং তার পক্ষে বিপক্ষে কথা চলতেই থাকবে। সেটলার্স গ্রামগুলো কোথাও কোথাও শান্তি বাহিনীর টার্গেট হয় ফলে এসব গ্রামকে কভার করে নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপন হয়। ১৯৮২ তে শান্তিবাহিনীতে মতাদর্শগত পার্থক্য শুরু হয় এবং দলীয় ফোরামে প্রীতি কুমার চাকমা যেনতেন প্রকারে একটা দ্রুত সমাধানে পৌঁছার প্রস্তাব দেন। এমএন লারমা প্রয়োজনে দীর্ঘ সময় আন্দোলন করে একটি পূর্ণ সমাধানে পৌঁছার মত দেন। এতে শান্তিবাহিনী ‘লাম্বা’ ও ‘বাদি’, ‘লং এন্ড শর্ট’ এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এরপর দুই দল নিজেদের মাঝে বিবাদ ও খন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয় আবার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষও চলতে থাকে।
বেসামরিক কর্মকর্তাদের অবস্থা হয় তখন ত্রাহি মধুসূদন! একাধিক কর্মকর্তা অপহৃত হন, নিখোঁজ হন ও নিহত হন। সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসেই অপহৃত হয়েছিলেন মহালছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। আরো পরে অপহৃত হয়েছিলেন ১৯৬৭ সালের ইপিসিএস বাঁশখালী’র সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, তিনি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর পরিচালক (অর্থ)। শান্তিবাহিনী তাঁর প্রচুর অর্থ আছে ভেবেছিল কি না কে জানে? তাঁর বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে মুক্তিপণের টাকা দেয়া হয়েছিল। আমি নিজেকে বলতাম এক লক্ষ টাকার বেয়ারার চেক, চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। আমার একমাত্র চিন্তা ছিল এই এক লক্ষ টাকা দিবে কে? সরকার কখনো সরকারী কর্মকর্তাদের এই মুক্তিপণের টাকা দেয়নি। সেনাবাহিনী সব সময় বেসামরিক কর্মকর্তারা নিজ অবহেলায় ধৃত হয়েছেন একথা প্রমাণ করার চেষ্টা চালাতো। এই পটভূমি পেছনে রেখে আমি রাত্রিবেলা আলুটিলায় সরকারী গাড়িতে সরকারী মালামালসহ স্পেয়ার চাকা ছাড়া আটকে আছি!