জালাল আহমেদ
‘ইজ্জতের লাঠি’ ইজ্জত বাঁচায়

খাগড়াছড়ি শহরে কোন পাঠাগার বা ভালো কোন বইয়ের দোকান না থাকায় আমার অসুবিধা হচ্ছিল। সূর্যমুখী নামে একটা নিউজপেপার এজেন্সী ছিল যা অধ্যাপক আবু তাহের চালাতেন। সেখানে কিছু ম্যাগাজিন পাওয়া যেতো। তবে তাঁকে দিয়ে আমি চট্টগ্রাম থেকে কিছু বই আনাতে পারতাম। তাহের সাহেব মারা গেছেন ৬/৭ বছর হয়। বাজারে কোন ভালো স্টেশনারী দোকান ছিল না, তবে প্রধান সড়কে বিলুপ্ত কসকর (কনজ্যুমার সাপ্লাইস করপোরেশন অফ বাংলাদেশ) একটা দোকান ছিল। স্বাধীনতার পর এই কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক ধারণা থেকে। তবে আমাদের প্রজন্ম কসকর দোকানে লাইন দিয়ে অনেক জিনিসই কিনেছে, কর্ডের প্যান্টপিস, রাশান জুতো, গুড়োঁ দুধ থেকে শুরু করে অসংখ্য ভোগ্যপণ্য। পরবর্তীতে এই করপোরেশন বিলুপ্ত করা হয়। কসকর এর দোকান থেকে অন্যকিছুর সঙ্গে প্রথমবারের মত জিলেট শেভিং ফোম কিনেছিলাম ১৩০ টাকা দিয়ে, এখনো আমি শেভ করতে জিলেট ফোম বা জেল ব্যবহার করি।
খাগড়াছড়ির অন্যতম বাস্তবতা ছিল চলাফেরার সীমাবদ্ধতা। খাগড়াছড়ি দিনে এক রকম আর রাতে আরেক রকম! সেখানে দিনের কাজকর্ম শুরু করতে হতো মাথার উপরে সূর্য উঠলে আর শেষও করতে হতো মাথার উপরে সূর্য থাকতে। প্রথম যেদিন আসি সেদিন এই বিষয়টি জানা ছিল না। পার্বত্য এলাকায় প্রধান সড়কগুলোতে রুট প্রটেকশন থাকতো। প্রতিদিন সকাল ৮টার মধ্যে নিকটস্থ সেনা/এপিবিএন/ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যরা সশস্ত্র অবস্থায় বের হয়ে রাস্তার দু’পাশে নির্দিষ্ট মাচানে অবস্থান নিতো। বিকেল ৪/৫ টায় আবার ফিরে যেতো। রাস্তার পাশের ২০০ ফুট করে জমি প্যাসিফিকেশন প্রোগ্রাম (শান্তকরণ কর্মসূচি) এর গম খরচ করে পরিস্কার রাখা হতো। জাঙ্গল ক্লিয়ারেন্স, যাতে রাস্তার পাশে নজর রাখা সুবিধা হয়। মজার জিনিস ছিল ‘ইজ্জতের লাঠি’, অস্ত্রের সঙ্গে এক টুকরো বাঁশ বাধা থাকতো লম্বা দড়ি দিয়ে (পরে জেনেছিলাম ৩০ ফিট), যা’ থাকার কোন কারণ নেই। পরে জানলাম যে শান্তিবাহিনীর আক্রমণে, বিশেষ করে পানিতে অনেক অস্ত্র হারানো গেছে, ইজ্জতের লাঠি থাকলে অস্ত্র পানিতে ডুবলেও বাঁশের টুকরা ফাতনা’র মত ভেসে থাকে, অস্ত্র খুঁজে পাওয়া যায়, ইজ্জতও বাঁচে, তাই ইজ্জতের লাঠি! সময়ানুগ রুট প্রটেকশনের ফলে সরকারী যানবাহন, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বেসরকারী যানবাহনও ৮-৪/৫টা এই সময়সীমা অনুসরণ করতো।
খাগড়াছড়ি জেলার তিনটি সেনা ব্যাটালিয়ন, একটি এপিবিএন, একটি সশস্ত্র আনসার ব্যাটালিয়ন এই দায়িত্ব পালন করতো। পরবর্তীতে আরো একটি সেনা ব্যাটালিয়ন, ১৯ ইস্ট বেঙ্গল এই ব্রিগেডে যুক্ত হয় অর্থাৎ ২০৩ পদাতিক ব্রিগেড ৪ ব্যাটালিয়নের ব্রিগেড হয়ে যায়। ১৯ ইস্ট বেংগল এর অধিনায়ক ছিলেন অকালপ্রয়াত লেঃ কর্ণেল মাহমুদ মতিন মোহাম্মদ কায়সার। প্রতিটি ব্যাটালিয়নের ৩টি কোম্পানীর আলাদা ক্যাম্প ছিল, কোম্পানী সমুহের প্লাটুন ভিত্তিকও আলাদা ক্যাম্প ছিল। তখন বর্তমান সেনানিবাসের জায়গা অধিগ্রহন করা হয় ও ৩৬ ইস্ট বেঙ্গল সেখানে স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ শুরু করে এবং ব্রিগেড সদর স্থাপনের কাজও শুরু হয়। খাগড়াছড়ি শহরের উত্তর-পূর্ব পাশে একটি বসতি আছে খাগড়াপুর নামে আর শহরের মাঝ দিয়ে যে ছড়ি চেঙ্গী নদীতে পড়েছে এটাই খাগড়াছড়ি, ছড়ির নামেই শহরের নাম। নদীর পাড়েই স্বাভাবিক নিয়মে বাজার গড়ে উঠে। শহর আর বাজার দুটোই সদর ইউনিয়নে, গোলাবাড়ী ইউনিয়নে। শুরুতেই যে জুড়িন্দা ফেরীর কথা উল্লেখ করেছি তাও গোলাবাড়ীতে, বাজারের অনেক খানি ভাটিতে। গোলাবাড়ি ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন হংসধব্জ চাকমা যিনি শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় ৭ সদস্যের কমিটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।
খাগড়াছড়ি বাজার সারিবদ্ধ কিছু দোকান ছাড়া যে কোন পাহাড়ী বাজারের মতো সাপ্তাহিক হাটও বসতো। পাহাড়ের মানুষ জন তাদের ভিটায় বা জুমে উৎপাদিত সামগ্রী ও কৃষিপণ্য নিয়ে বাজারে আসতো। সাধারণতঃ এপ্রিল মাসে পাহাড়ে জুমের আগুন দেয়া হত, পাহাড়ের সমস্ত ঘাস, ঝোপঝাড় পুড়ে ছাই হতো। কখনো বড় গাছও পুড়তো সংগে কিছু বুনো প্রাণী। প্রথম বৃষ্টির পরে জুম চাষের প্রস্তুতি, ধারালো বহুমুখী ব্যবহারের দা, তাগল দিয়ে মাটিতে গর্ত করে একই গর্তে বিভিন্ন বীজ লাগানো হত আর প্রায় ৮ মাস ধরে একটার পর একটা সব্জী বা ফসল আসতে থাকতো। পাহাড়ের লোকজন নাপ্পি খায়, নাপ্পি আমাদের সিলেটি চ্যাপা শুঁটকি বা সিঁদল এর সিনিয়র, আরো বেশি ‘ফারমেন্টেড’, গন্ধও তথৈবচ। তাই নাপ্পি নিয়ে বাজারে বসার সুযোগ নাই, বাজারের বাইরে নির্দিষ্ট স্থানে নাপ্পিওয়ালারা বসে। ওসি বাজার ফান্ড হিসেবে ৩৪টি হাটবাজার বন্দোবস্তসহ দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল আমার। সবগুলো বাজারই ছিল অপরিকল্পিত, ঘিঞ্জি। কেবল মাটিরাঙ্গা পুরো বাজার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় ‘অন ক্লিন স্লেট’ বাজারটিকে পরিকল্পিত বিন্যাসে সাজাতে পেরেছিলাম। বাজারগুলোতে পাহাড়ি মানুষের কোন স্থায়ী দোকান ছিল না। আমি নিয়ত করে কিছু পাহাড়ী লোককে দোকান দেবার চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এগুলোর মালিকানা পরিবর্তন হয়ে যেতো। পাহাড়ী সহজ সরল মানুষ দোকানে বসে অনেক পণ্যের ব্যবসায়ে তখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠে নাই। শহর ছিল বাজার চৌরাস্তা কেন্দ্রীক, পরবর্তীতে চেংগী সেতু হবার পর শহরের মূল চৌরাস্তা বাজার থেকে সরে চেংগী সেতুর মুখে চলে যায়।