হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির এক জটিল সমীকরণ!
ড. মোহাম্মদ শাহ্ নেওয়াজ

প্রায় ছয় বছর আগে ২০১৪ সালে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক বিশাল জনসমাবেশে হবিগঞ্জবাসীর পক্ষে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমমন্ত্রীর নিকট অন্যান্য দাবি-দাওয়ার সাথে হবিগঞ্জে একটি কৃষি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবি জানান। সভায় উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এমপি আবু জাহিরের এই দাবি সমর্থন করে বক্তব্য দিলে সরকারের নিকট উত্থাপিত দাবি সমূহের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। আওয়ামী রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই দাবির প্রেক্ষিতে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, জননেত্রী শেখ হাসিনা হবিগঞ্জবাসীর এই যৌক্তিক দাবি পূরণে তাঁর সরকারের পক্ষে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলেন, “হবিগঞ্জে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে”।
অ্যাডভোকেট আবু জাহির এমপি’র নিরলস প্রচেষ্টায় গত ১০ই সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর হবিগঞ্জের সমাবেশে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে মহান জাতীয় সংসদে “হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০২০” বিলটি পাশ হয়। গত ১৫ই সেপ্টেম্বর সংসদে পাশকৃত বিলে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ স্বাক্ষর করার ফলে এটি আইনে পরিণত হয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একই দিনে এই আইনের একটি গেজেট প্রকাশ করে। এই গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়ে হবিগঞ্জবাসী তাদের কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয় পেয়ে আনন্দিত, গর্বিত। তাঁরা পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হবিগঞ্জে একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আইন পাশ করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জেলার নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
“হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০২০” প্রণয়নে নিজেদের কৃতিত্বের জানান দেয়া ও বিশ্ববিদ্যালয় আইনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি তাঁদের প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের জায়গা “হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায়” নির্দিষ্ট করে দেয়ার প্রেক্ষিতে হবিগঞ্জ জেলা থেকে নির্বাচিত দুইজন সংসদ সদস্য নিজ নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন ও সভা করে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি নাগুড়া ফার্ম এলাকায় স্থাপিত হবার কথা ছিল বলে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্যের পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। নির্মিতব্য বিশ্ববিদ্যালয়টি হবিগঞ্জ জেলার কোন উপজেলায় স্থাপিত হবে এ নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে বড় কোন মাথা ব্যাথা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং হবিগঞ্জ জেলায় সরকার একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবে এতেই জনগণ খুশি। তবে কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন প্রস্তাবিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টির বিশেষায়িত প্রকৃতি ও নাগুড়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এলাকায় প্রায় ৮৬ একর সরকারি ভূমি ও ব্যবহারযোগ্য অন্যান্য সুবিধাদি থাকায় নাগুড়াতেই স্থাপিত হবে। কিন্তু নাগুড়া হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলায় অবস্থিত হওয়ায় হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের আওতায় অত্র এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন অসম্ভব। কারণ হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করতে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি ও সার্বিক বিবেচনায় নাগুড়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে কেন্দ্র করেই হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে উঠুক এমনটি আমিও চাই। বানিয়াচংয়ের সন্তান হিসেবে বর্তমান সরকারের “সুষম উন্নয়ননীতি” বাস্তবায়নে ন্যায্যতার ভিত্তিতে আমার এই চাওয়া আরও বেশি জোরালো।
হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা, রাজনীতিকদের বক্তব্য ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের পর্যালোচনা করলে একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কর্তৃক সঠিক সময়ে, যথাযথ স্থানে, কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বানিয়াচং উপজেলাবাসী একটা বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় বুকে ধারণ করার সুযোগ পেত। সরকারী অর্থের সাশ্রয়, সম্পদের সদ্ব্যবহার ও জেলার প্রতিটি উপজেলায় সুষম উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হত।
সম্প্রতি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আইন পাশ করার কৃতিত্ব দাবি করে রাজনীতিকদের পরস্পর বিরোধী (এমনকি কখনো কখনো স্ববিরোধী) বক্তব্য ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের প্রেক্ষাপটে নিচে আমার উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থনে কিছু তথ্য তুলে ধরার প্রয়োজনীতা অনুভব করছি।
হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০২০ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়টি হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় স্থাপনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নতুন এই আইনে হবিগঞ্জ কৃষি বিদ্যালয় স্থাপনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্থান নির্বাচন, ভূমি অধিগ্রহণ, মাটি ভরাট ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করতে কর্তৃপক্ষকে আরও অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে। অথচ বহুল প্রত্যাশিত নাগুড়া এলাকায় ব্যবহারের উপযোগী সরকারি মালিকানাধীন পর্যাপ্ত ভূমি ও কিছু স্থাপনা থাকার সুবাধে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একজন উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে তুলনামূলকভাবে অতি কম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা যেত। সঙ্গত কারণে নাগুড়া ফার্ম এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হলে সরকারের অর্থের সাশ্রয় হত এবং হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইনটি বাস্তবায়ন অধিকতর সহজ ও ত্বরান্বিত হত।
একই সাথে এই প্রস্তাবিত এলাকা (নাগুড়া) বানিয়াচং, নবীগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী হওয়ায় অত্র এলাকার মানুষের জীবন মানের অনেক উন্নতি হত। কিন্তু আমরা ভিন্ন একটি বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করলাম!
হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০২০ – বিল আকারে মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের পূর্বে বিলের ছাপানো কপি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন সপ্তাহের শুরুতে ও যেদিন বিলটি সংসদে পাশ হয় সেদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের, ১০ই সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখের পূর্বে সকল সংসদ সদস্যগণের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
আমার মতে এই আইনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান প্রতিবেদনটি পড়ে বিলটি সংসদে উপস্থানের পূর্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে সহজেই এই কঠিন বাস্তবতা এড়ানো যেত। এমনকি যেদিন জাতীয় সংসদে এই বিলটি পাশ হয় সেদিনও যদি এমপি মহোদয় নিজে সংসদে উপস্থিত থেকে এই ব্যাপারে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্য রাখতেন তবে তা একটি দলিল হিসেবে সংসদে দিনের কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ থাকত। কিন্তু অপ্রিয় সত্য হল এমপি মহোদয় কোন অজানা কারণে সেদিন সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন।
মহান জাতীয় সংসদ হচ্ছে আইন প্রণয়ন, সংশোধন এমনকি আইন বিলুপ্ত করণের উপযুক্ত স্থান। একজন নির্বাচিত এমপি জনগণের দাবি-দাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা, পছন্দ ও স্বপ্নের কথা মহান জাতীয় সংসদে তুলে ধরবেন সাধারণ জনগণ হিসেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।