জালাল আহমেদ
চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ঘুরে দেখতে পেরেছি
রাজা রামনাথের রামসাগর সবসময়ই আমাকে মুগ্ধ করে তার বিশাল জলাধার দিয়ে আর এখন প্রচুর গাছগাছালি এর সৌন্দর্য্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজা রামনাথ এর আরেক অমর কীর্তি কান্তজিউ মন্দিরের নির্মাণ ১৭০৪ সালে রাজা প্রাণনাথ শুরু করেন। রাজা রামনাথের সময়ে ১৭৫২ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। কান্তজিউ মন্দির টেরাকোটা কাজের এক অবিস্মরণীয় প্রদর্শনী। শত শত টেরাকোটায় বিধৃত হয়েছে রামায়ন মহাভারতের কাহিনীসহ সমকালীন সাধারণ মানুষের জীবনালেখ্য

আমি ছোটবেলা থেকেই ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতাম। আমি এসএসসি পরীক্ষা দেই আমার ষষ্ঠ স্কুল থেকে। শুরু সেইন্ট মেরী, জামালখান চট্টগ্রাম, আবুল কাসেম সরকারী প্রাইমারী স্কুল (কাউয়া স্কুল নামে পরিচিত ছিল) চট্টগ্রাম, ধানমন্ডি হাই স্কুল, হাতিরপুল ঢাকা, বুল্লা সরকারী প্রাইমারী স্কুল লাখাই হবিগঞ্জ, টাউন মডেল সরকারী প্রাইমারী স্কুল হবিগঞ্জ এবং হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়। ফলে দশ বছর বয়সের মধ্যেই আমার অনেকখানি ঘোরাফেরা হয়ে গিয়েছিল। তখন আমার মাথায় একটা অদ্ভুত চিন্তা ছিল যে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে আমি দু’বছর কোন চাকরি করবো না, ঘুরে বেড়াবো বাংলাদেশের সব থানা। ইতিহাস আমার প্রিয় বিষয় ছিল এবং এখনো প্রিয়, ইতিহাসের মধ্যেও প্রিয় হলো স্থানীয় ইতিহাস। তাই দেশের প্রত্যেক অংশ ঘুরে সেসব এলাকার নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দেখার একটা প্রবল আগ্রহ আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল। যদিও তা করতে পারিনি তবে পরবর্তীতে চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ঘুরে দেখতে পেরেছি। দেখেছি অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা। এসএসসি পরীক্ষার পর ইচ্ছা প্রকাশ করলাম যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরতে যাবো, মূলতঃ আত্মীয়-স্বজনের বাসায়। বাসা থেকেও সম্মতি পাওয়া গেলো। সম্ভবতঃ মে মাসে হবিগঞ্জ থেকে ঢাকা আসি। ১৯৭৬ সালের মে মাসে ফারাক্কা মিছিল হয়েছিল। মওলানা ভাসানীর আহ্বানে ভারত কর্তৃক একতরফাভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে পদ্মা নদীর পানি প্রত্যাহার করার বিরুদ্ধে ফারাক্কা অভিমুখে এক মিছিল রাজশাহী পর্যন্ত যায়। আমার আগ্রহ ছিল এই মিছিলে যোগ দেবার কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় আমি মিছিলে যোগ দিতে পারিনি কিন্তু মৌলানা ভাসানীর এই উদ্যোগে আমার নীতিগত সমর্থন ছিল।
হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসি, এর আগেও ঢাকায় এসেছি অনেকবার। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ এ যখন মেঘনা নদীর উপর ভৈরব রেলসেতুর দুটি স্প্যান ভাংগা ছিল তখন নৌকায় নদী পার হতে হতো। ঢাকায় বড় চাচা ছিলেন, দুই মামা ছিলেন ফলে তিন বাসা মিলিয়ে বেড়ানো ভালোই চলছিল। আর চলছিল পুরনো ঢাকায় হাঁটাহাঁটি। চাচার বাসা ছিল আজিমপুর সরকারী কলোনীতে। একটু এগিয়ে সলিমুল্লাহ এতিমখানা পার হলেই পুরনো ঢাকা। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কোনায় আজাদ অফিস ছিল। আজাদ অফিস ডানে রেখে কিছুদুর এগুলেই লালবাগ কেল্লা, তার উল্টোদিকে, একটু এগুলে খান মোহাম্মদ মৃধার মসজিদ, চকবাজার, নওয়াব বাড়ি, জগন্নাথ কলেজ, বাহাদুরশাহ পার্ক, সূত্রাপুরের লোহার পুল। এসবের বেশির ভাগ তখন পায়ে হেঁটে দেখা। চিড়িয়াখানা এলাকা তখনো ফাঁকা ফাঁকা। মীরপুর চিড়িয়াখানার বয়স তখন মাত্র দু’বছর, তার গড়ে উঠার সময়। এর আগে চিড়িয়াখানা দেখি হাইকোর্ট এলাকায়। হাইকোর্টের নতুন বিল্ডিং আর পুরনো সড়ক ভবনের জায়গায় ছিল এই চিড়িয়াখানা, আমি প্রথম ভিজিট করি ১৯৬৭ সালে। চাপাচাপি করে রাখা বুনোপ্রাণীদের প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। সে তুলনায় তখনকার মীরপুর চিড়িয়াখানা ছিল অনেকখানিই খোলামেলা।
আর নিমতলীর নায়েব নাজিম এর প্রাসাদে তখনো টিকে থাকা “বারদুয়ারী”তে তখনকার ঢাকা যাদুঘর দেখা ছিল বিশেষ অভিজ্ঞতা।
এক মামা থাকতেন দিনাজপুরে, এক মামাতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলাম দিনাজপুর। ছিল দ্রুতযান ট্রেন, বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ি ঘাট (তিস্তামুখ ঘাট) হয়ে দিনাজপুর যেতো। ময়মনসিংহ জামালপুর হয়ে ঘাটে আসা, দৌড়ে বালুচর পার হয়ে ফেরীতে উঠা এবং নদী পার হয়ে বালুচরে স্থাপিত অস্থায়ী ভাতের হোটেলে নদীর তাজা মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার কথা এখনো মনে পড়ে। বালুচরে গরম ছিল প্রচন্ড কিন্তু ভ্রমণপিয়াসু কিশোর মনে তার কোন প্রভাব ছিল না। কিছুক্ষণ পর আবার ট্রেন ধরার জন্য দৌঁড়। ফুলছড়ি ঘাট থেকে পার্বতীপুর জংশন হয়ে দিনাজপুর। দিনাজপুরে তখন প্রচন্ড গরম, লিচুর মৌসুম, গাছে গাছে কিছু আমও আছে খাওয়ার উপযোগী। হবিগঞ্জ বা দেশের পূর্বাঞ্চলের তুলনায় দিনাজপুরে লোকবসতি কম। দিনাজপুর শহরও ছিল ফাঁকা, রিক্সা ভাড়া ছিল আমাদের এলাকার অর্ধেক। মামার বাসা কাঞ্চন রেলসেতুর কাছে চাউলিয়া পট্টি, চারিদিকেই ফাঁকা ফাঁকা। কাঞ্চন নদীতে হাটু পানি, কোমর পানি, সে পানিতেই প্রাণ ভরে গোসল আর কাঞ্চনের সুস্বাদু ছোট মাছ খাবার কথা মনে পড়ে। কয়েকদিন পর মামীর এক আত্মীয় বাড়িতে যাই দিনাজপুরের এক গন্ডগ্রামে। বিশাল সব মাটকোঠা, মাটির ঘর, দোতলাও আছে যা আমাদের সিলেট এলাকায় নাই। অনেক বড় আঙ্গিনা নিয়ে ঘেরা ছিল ঐ বাড়ি। চারিদিকে ফলের গাছ, গাছ থেকে পেড়ে আম লিচু খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। দুপুরের খাবার দেয়া হলে ঘরের আঙ্গিনায় বসে প্রথমবারের মত বড় এক থালায় সব খাবার এক সঙ্গে নিয়ে খাওয়া, এখন যাকে থালি হিসেবে চিনি, ভেজ অর নন-ভেজ থালি।
একদিন দিনাজপুরের মডার্ন সিনেমা হলে ছবি দেখি প্রচন্ড গরমে সেদ্ধ হয়ে। দিনাজপুরের অবশ্য দর্শনীয় রামসাগর, কান্তজিউ মন্দির আর দিনাজপুর রাজবাড়িও তখনই দেখা হয়ে যায়। দিনাজপুরের রাজ পরিবার সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে এতদাঞ্চলের অত্যন্ত বড় জমিদার ছিলেন। রাজবাড়ির অবস্থা সেই ১৯৭৬ সালেই খারাপ ছিল আর এখন তো বলার মতো নয়। রাজবাড়ির আশেপাশে বেশ কয়েকটা দিঘি ছিল। তারমধ্যে দু’একটাতো অনেক বড়। রাজবাড়ির মন্দিরটা সেসময় খুবই ভালো লেগেছিল বিশেষ করে পাথরের কারুকাজ করা দরজার চৌকাঠ। মন্দিরটাকে এখন নষ্ট করা হয়েছে বিদ্ঘুটে রঙ করে। রাজা রামনাথের রামসাগর সবসময়ই আমাকে মুগ্ধ করে তার বিশাল জলাধার দিয়ে আর এখন প্রচুর গাছগাছালি এর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজা রামনাথ এর আরেক অমর কীর্তি কান্তজিউ মন্দিরের নির্মাণ ১৭০৪ সালে রাজা প্রাণনাথ শুরু করেন। রাজা রামনাথের সময়ে ১৭৫২ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। কান্তজিউ মন্দির টেরাকোটা কাজের এক অবিস্মরণীয় প্রদর্শনী। শত শত টেরাকোটায় বিধৃত হয়েছে রামায়ন মহাভারতের কাহিনীসহ সমকালীন সাধারণ মানুষের জীবনালেখ্য। দিনাজপুর বেড়ানো শেষ করে বাসে করে ফিরে আসি। তখন দিনাজপুর থেকে বিআরটিসি বাস ছিল, কত ঘন্টার ভ্রমন ছিল এখন আর তা মনে নেই, এগারো/বারো ঘন্টাতো হবেই। দিনাজপুর থেকে সৈয়দপুর-রংপুর-গাইবান্ধা-বগুড়া-পাবনা হয়ে নগরবাড়ি ঘাটে পৌঁছাই। সেখান থেকে বিশাল ফেরী, চার ঘন্টা সময় লাগে যমুনা পার হতে, ফেরীতে হাফ-ইলিশ ভাজা খাবার স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। এপাড়ে আরিচা ঘাট, তখনো “দেখা আরিচার ঘাটে” গান লেখা হয়নি আর শাহজালাল নামে কোন ফেরীও চালু হয়নি। তারপর মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকা ফিরে আসি। তখন থেকেই মূলতঃ ভ্রমন করতে ভালোবাসি। আর ঘুরে ঘুরে দেশ আর দেশের মানুষকে না দেখলে কোন পুঁথিগত জ্ঞানই সম্পূর্ণ হয় না বলেই আমি বিশ্বাস করি।