গায়েবী গজার মাছের ঘাটকে কেন্দ্র করে প্রচলিত রয়েছে নানা কাহিনী
মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার দাউদনগর গ্রামের দক্ষিণ অংশে রয়েছে বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) এর গায়েবী গজার মাছের ঘাট ও তার ভাই শাহ সৈয়দ হাছান উল্লা (রহ.) ওরফে সৈয়দ নাছির প্রকাশ ছাওয়াল পীর বা জিন্দা শিশু পীরের মাজার। গায়েবী গজার মাছের ঘাটটি এলাকার লোকজনের কাছে মাছের ঘাট হিসেবেই পরিচিত। এ মাছের ঘাটকে কেন্দ্র করে নানা কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।
হবিগঞ্জের প্রাক্তন জমিদার ও প্রাক্তন অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ উবেদুর রহমান ওরফে গাজী মিয়া বৈবাহিক সূত্রে উত্তরাধিকারী হিসেবে শায়েস্তাগঞ্জের দাউদনগর সৈয়দ বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। সৈয়দ বাড়ির অপর অংশে সৈয়দ শাহ দাউদ (রঃ) এর বংশধরগণ বাস করছেন। বন্দেগী শাহ সৈয়দ দাউদ (রহ.) এর দুই পুত্র ছিলেন। একজন হলেন বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) ও অপরজন হলেন শাহ সৈয়দ হাছান উল্লা (রহ.) ওরফে সৈয়দ নাছির প্রকাশ ছাওয়াল পীর বা জিন্দা শিশু পীর। বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) একজন কামেল পীর ছিলেন। বর্তমান দাউদনগর বড় হাবেলীতে বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) এর বসতি ছিল। বড় হাবেলীতে আজও সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) এর বসতভিটা, তার ব্যবহৃত হাতের বাজু এবং পায়ের খড়ম তারই পরবর্তী বংশধর সৈয়দ বদিউজ্জামান ফয়সলের কাছে সুরক্ষিত আছে। শায়েস্তাগঞ্জ মাছের ঘাটের স্বত্ত্বাধিকারী বড় হাবেলীর বাসিন্দা সৈয়দ বদিউজ্জামান ফয়সল এ তথ্য জানান। তিনি বলেন- আজও বিভিন্ন রোগ শোক থেকে মুক্তি পেতে ভক্তসহ এলাকার লোকজন বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) এর পায়ের খড়ম ধুয়া পানি নিয়ে যায়। বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) বর্তমান মাছের ঘাট বলে পরিচিতি পুকুর পাড়ে ইবাদত বন্দেগী করতেন। পূর্বে পুকুরটির মধ্যে একটি কুয়া ছিল। বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) হঠাৎ একদিন লক্ষ করেন তার মাথার উপর দিয়ে দেও দানব চলে যায় এবং সামনে যা পায় তা খেয়ে ফেলে। বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) এই দেও দানবকে বন্দী করে গজার মাছে রূপান্তর করে কুয়ার মাঝে ফেলে দেন। এই কুয়া পরবর্তীতে পুকুরে পরিণত হয়। বড় হাবেলীতে বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) এর পরবর্তী বংশধরগণ হলেন- সৈয়দ ফজল উল্লা, সৈয়দ আফজল মিয়া, সৈয়দ আব্দুর রহমান, সৈয়দ ফজলুর রহমান, সৈয়দ আনজবুর রহমান, সৈয়দ আলীবুর রহমান। সৈয়দ আলীবুর রহমানের ২ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তান ছিলেন। তারা হলেন- সৈয়দ সুফিয়া, সৈয়দ কামরুজ্জামান, সৈয়দ আয়েশা ও সৈয়দ বদিউজ্জামান ফয়সল।
এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) তৎকালিন সময়ে দাউদনগর বড় হাবেলীর বড় বাড়িতে বসবাস করতেন। তিনি খুব বেশি ইবাদত বন্দেগী করতেন। আর তা পুকুর পাড়ের ছোট একটি ঘরে বসে করতেন। সেই সময় ইবাদতখানার পাশে ছোট একটি ডোবারকম ছিল। বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) যখন ইবাদতে মশগুল থাকতেন তখন তার মাথার উপর দিয়ে দেও-দানব, জ্বিন-পরী যাতায়াত করত এবং তার কাছে মুরিদ হওয়ার জন্য আবদার করতো। তিনি তখন তাদের বলতেন- তোমাদের মুরিদ করতে পারি এ শর্তে তোমরা দেও-দানব, জ্বিন-পরী থেকে মাছের রূপ ধারণ করতে হবে। তখন তারা উত্তর দিয়েছিল আমরা মাছ হলে খাওয়াবে কে? তিনি তখন উত্তর দিয়ে ছিলেন মানুষ তোমাদের খাওয়াবে। সেই সময় থেকে বন্দেগী শাহ সৈয়দ মহিব উল্লা (রহ.) দেও-দানবকে বন্দী করে গজার মাছ রূপ ধারণ করিয়ে ডোবায় রাখেন।
কথিত আছে গজার মাছের ছোট ডোবাকে বড় করে খনন করে দেয়ার জন্য স্বপ্নে দেখেন বিরামচর গ্রামের হিন্দু জমিদার কাশী চন্দ্র বিশ্বাস। এ সময় তার পুত্র ও পৌত্ররা নিজ খরচে ডোবাটি খনন করেন। প্রতিদিন এ পুকুরের গায়েবী গজার মাছ দেখতে ভিড় জমান হাজারো ভক্ত নারী পুরুষ। গায়েবী গজার মাছ দেখতে আসা কয়েকজন ভক্ত জানান- অসুখ বিসুখে এ পুকুরের পানি পান করলে উপকার পাওয়া যায়। তাই মাছ দেখতে আসা অনেক ভক্ত ফিরে যাওয়ার সময় বোতলে করে পুকুরের পানি নিয়ে যান।
মাছের ঘাটের পাড়ে শায়িত আছেন সৈয়দ আব্দুর রহমান ওরফে আবড়া মিয়া। এ স্থানটিকে পাকা দেয়াল ঘিরে মাজার সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনিও একজন কামেল ব্যক্তি ছিলেন। সৈয়দ আব্দুর রহমান কথা বলতে সমস্যা হতো। তাই লোকজন তাকে আবড়া মিয়া নামে ডাকতেন। তার মাজারের সন্নিকটেই রয়েছে ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম যাতায়াতের রেল লাইন। স্থানীয় লোকজন জানান- মাজারের দিকের রেল লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করে না। কারণ অতীতে ওই লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ট্রেন পড়ে যেতো। পরে এই লাইন ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী অন্য লাইনগুলো দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয় যা আজও বিদ্যমান রয়েছে।
সৈয়দ বদিউজ্জামান ফয়সল আরও জানান- ১৯৮৮ সালের বন্যার পর দুষ্কৃৃতিকারীরা পুকুরে বিষ ফেলে দেয়। তাদের ধারণা এতে পুকুরের সব মাছ মারা যাবে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে কয়েকদিন পর আবারও পুকুরের পানিতে জীবন্ত গজার মাছ ভেসে উঠে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে রাতের আঁধারে দুষ্কৃৃতিকারীরা পুনরায় পুকুরে বিষ প্রয়োগ করে। এতে দেশীয় প্রজাতির মাছ সহ প্রায় ১২০টি গজার মাছ মারা যায়। পরে দমকল লাগিয়ে পুকুরের পানি সেচে বাহির থেকে নতুন পানি এনে পুকুর ভরাট করা হয়। মারা যাওয়া গজার মাছ মাটি চাপা দেয়া হয়। সপ্তাহখানেক পর দেখা যায় আবারও পুকুরে গজার মাছ ভাসছে। এ খবর পেয়ে ভক্ত আশেকানরা মাছ দেখতে ছুটে আসেন।