জালাল আহমেদ
হবিগঞ্জের তৎকালীন এসডিও ড. আকবর আলি খানকে দেখেই স্বপ্ন জাগলো এসডিও হবার, সিভিল সার্ভিসে যোগদান করার

এখন থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে ১৯৬১ সালে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলায় পশ্চিম বুল্লা গ্রামে মামার বাড়িতে আমার জন্ম। জন্মের পর এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পেশাগত জীবন শেষ করেছি। মানুষের শৈশব কৈশোর হলো যৌবন ও মধ্যবয়সের প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতি যত ভালো হবে পরের জীবনও ততখানিই ভালো হবার কথা, ব্যতিক্রম নিয়মকেই প্রতিষ্ঠিত করে। আমার আব্বা অ্যাডভোকেট মোঃ আব্দুর রহমান ভিন্ন পেশা থেকে এসে ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৯৬ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত হবিগঞ্জে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। একসময় তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেও যোগদান করে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম শ্রেণী হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি উঁচু মানের নৈতিকতা বজায় রেখেছিলেন এবং আমাদেরকেও সেই শিক্ষাই দিয়েছিলেন। আমি ১৯৬৯ সালে হবিগঞ্জ টাউন মডেল পাঠশালায় ও ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়েছি। তারও আগে চট্টগ্রাম, ঢাকা, বুল্লা মিলিয়ে আরো চারটি স্কুলে পড়েছি। তবে আমার মূল গড়ে উঠার সময় ১৯৭০-১৯৭৮ হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় ও বৃন্দাবন সরকারী কলেজ। আমি যা মনে করি এই সময়টাতেই একজন মানুষ তার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে চিন্তা করতে পারে এবং তদনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে তাঁকে অনেকেই প্রভাবিত করে, করতে পারে, তবে মূল সিদ্ধান্ত তার নিজেরই নেয়া উচিত। এখানে আমি আমার শিক্ষকদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তবে প্রত্যেককে নিজের যে ঝোঁক, এটিচ্যুড তা বুঝতে হবে এবং সেটাই অনুসরণ করতে হবে। আর এখনকার সময়ে বিভিন্ন পেশায় কাজ করার সুযোগও বেড়েছে। আমাদের ছোটবেলায় বিষয়টি অতো সহজ ছিল না, এখনো নয়, তবে এখন সহজতর। আমি আমার এই লেখায় আমার নিজের অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করবো এবং এই বয়সে এসে তা করা যায় হয়তো। কেউ কেউ একে প্রাসঙ্গিক হিসেবে পেতে পারেন এবং নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে পারেন। আমি লেখক নই, সকল তথ্য মনে না থাকার কারণে তথ্যগত ভ্রান্তি থাকতে পারে। কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তথ্যগত ভ্রান্তি সংশোধন করে নেব।
প্রত্যেকের জীবনে “ঈযড়ড়ংরহম ড়ভ ধ পধৎববৎ” বা পছন্দসই পেশা বেছে নেয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একজনের নিজের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হওয়া উচিত। আমার ক্ষেত্রেও তাই ছিল। আমি যখন ছোট তখন নিশ্চয়ই ছোটরা যেমন করে জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে তেমন করেই লক্ষ্য ঠিক করেছিলাম, পাইলট হবো বা বাস চালাবো বা ট্রেনের ড্রাইভার বা মুদি দোকানদার (লেবেঞ্চুষ খাবার লোভে!) হবো। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই হয়তো এ থেকে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম, কারণ ছোট বয়সেই আমি সিভিল সার্ভিসে আসতে হবে এ চিন্তা করতে পেরেছিলাম এবং সিভিল সার্ভিস প্রশাসনে আসার লক্ষ্যস্থির করতে পেরেছিলাম। তখন যে খুব একটা মহৎ কিছু চিন্তা করে এটা করেছিলাম তা নয়। বিষয়টা ছিল খুব সহজ, ১৯৭০ সালে আমি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি আর আকবর আলি খান সিএসপি হবিগঞ্জের এসডিও, সাবডিভিশনাল অফিসার, মহকুমা প্রশাসক। এই পদটি এখন আর নেই, ১৯৮৪ তে বিলুপ্ত হয়েছে। তখন সাবডিভিশনাল অফিসার ও সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট প্রশাসনিক পদ বিন্যাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারির আগে দেশে জেলা ছিল ২২টি। মহকুমা ছিল ২২টি সদর মহকুমা ও ৪৬টি সদর বহির্ভূত মহকুমা। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ২২টি সদর মহকুমা বিলুপ্ত করা হয় আর সদর বহির্ভূত ৪৬টি মহকুমা থেকে ৪২টি কে মানউন্নীত করে জেলা করা হয়। যে চারটি মহকুমা জেলা না হয়ে উপজেলা হয় সেগুলো হলো রামগড়, কাপ্তাই, লামা ও পটিয়া। হবিগঞ্জের তৎকালীন ৮টি থানা ছিল মহকুমা প্রশাসনের অধীন আর মহকুমা প্রশাসক ছিলেন ১৯৬৭ ব্যাচ এর তরুণ সিএসপি ড. আকবর আলি খান, তাঁকে দেখেই মুগ্ধতা আর এই সার্ভিসে আসার আগ্রহ।
যুবক আকবর আলি খানও ছিলেন নেতৃত্বগুণসম্পন্ন এক অসধারণ কর্মকর্তা। আমার আব্বা ছিলেন একজন অ্যাডভোকেট ফলে মহকুমা হাকিম বা সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট এর আদালতের প্রতিদিনের অনেক কিছুই বাসায় আলোচনা হতো। আব্বার মুখে এসডিও সাহেবের প্রশংসাই শুনতাম, তাঁর কাজের ধরণ, ব্যক্তিত্ব, সততা ও জ্ঞান। আমার এক মামাতো ভাই পড়তো হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে, তাঁদের ইংরেজীর শিক্ষক ছিল না। ক্লাশ নিতেন ওই এসডিও সাহেব। আর মহকুমা শহরের সকল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুতেও ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যখন পাক হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের উপর তখনো তিনি ভুল করলেন না। ট্রেজারী খুলে অস্ত্র দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের আর এপ্রিল মাসে তিনি যোগ দিলেন মুজিবনগরে, কাজ করলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে। যেদিন দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেলেন ঐদিন তাঁর সংগে আমার দেখাও হয়। এহেন ড. আকবর আলি খানকে দেখেই স্বপ্ন জাগলো এসডিও হবার, সিভিল সার্ভিসে যোগদান করার। এই স্বপ্ন নিয়েই বড় হতে লাগলাম। আকবর আলি খানকে আমরা অনেকেই চিনি, টকশোতে তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণের জন্য। অনেকে চিনি অসাধারণ সব কৌতুহলোদ্দীপক বই এর রচয়িতা হিসেবে। অনেকে চিনি তাঁকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হবার কারণে। তারও আগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব। মন্ত্রিপরিষদ সচিব হবার আগে পাঁচ বছরেরও বেশী সময়কাল তিনি ছিলেন অর্থ সচিব। তখন আমারও সুযোগ হয়েছিল অল্পদিন উপসচিব পদে তাঁর সঙ্গে অর্থ বিভাগে কাজ করার।