পাঠকের কলাম

॥ সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহীম ॥

অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পরও কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না লোকটার। এক পর্যায়ে কিছু খাবেন কি-না জিজ্ঞেস করতেই ধমকের সুরে উত্তর দিলেন ঠান্ডা খাবো। সাথে আর কিছু কি দিব। সহজ উত্তর কি দিবেন। আরও দিতে চান। কি দিতে চান। অবস্থা অনুকুলে মনে না হওয়ায় শেষে পাশের দোকান থেকে একটা ম্যাংগু জুস আর কিছু ড্রাই কেক কিনে দিলাম।
স্থানীয় বাসিন্দা ফারহান মিয়ার সাথে প্রথমেই পরিচিত হয়ে তার কাছ থেকে জানতে পারলাম প্রায় ৪ মাস পূর্বে লোকটা এখানে এসে আশ্রয় নেয়। তখন সুস্থ স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল। কোন কিছু খাবে কি-না জিজ্ঞেস করলেই বলত বিড়ি খাবো। বিড়িই তার প্রধান খাবার। বেশির ভাগ সময় বিড়ি খেতেই দেখেছেন ফারহান মিয়াসহ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ভবঘুরে অবস্থায় লোকটাকে তারা নিয়মিতই খোয়াই নদীর পাড়ে পৌরসভার ফেলা ময়লা আবর্জনা থেকে উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে এনে খেতে দেখতেন। এক পর্যায়ে লোকটাকে দুর্বল হয়ে পড়তে দেখে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ফারহান মিয়াদের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় পুরনো কাপড় দিয়ে থাকার জায়গা করে দেন। সেই থেকে একই স্থানে প্রায় চার মাস যাবত অবস্থান করছে লোকটা। কেউ কোন প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না সে। তখন আশপাশের ব্যবসায়ীসহ স্থানীয় বাসিন্দারা মাঝে মধ্যে তাকে খাবার দিতেন। কিন্তু কথা না বলায় কেউ বুঝতেন না তার অনুভুতি। ফলে অনেক সময় পানির পিপাসা হলে সে প্র¯্রাব করে তা-ই খেয়ে ফেলত। দীর্ঘদিন অর্ধাহারে অনাহারে থাকতে থাকতে সে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে এখন উঠে দাঁড়াতেও পারছে না। এমতাবস্থায় লোকটির পাশে এসে দাঁড়ায় তাসনুভা শামীম ফাউন্ডেশন। প্রতিদিন নিয়মিত লোকটির কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন তাসনুভা শামীম ফাউন্ডেশনের সদস্য স্কুলছাত্র সানি। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সারাদেশ লকডাউন হয়ে যাওয়ায় গত ৪/৫ দিন ধরে ফাউন্ডেশন থেকে খাবার পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফারহান মিয়া প্রায়ই লোকটিকে ভাতসহ বিভিন্ন খাবার পরিবেশন করে আসছেন। শারীরিক দুর্বলতার কারণে লোকটি খাবারও ঠিকমত খেতে পারছে না। ফলে ক্রমশই সে আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে।
গত রবিবার তাসনুভা শামীম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আয়ারল্যান্ড প্রবাসী মোঃ সাগর আহমেদ শামীম মোবাইলে ফোন করে আমাকে লোকটার খোঁজ নিতে বলেন। মূলত শামীম ভাইয়ের কথায়ই আমি লোকটার খোঁজে গতকাল সোমবার দুপুরে বের হই এবং সেখানে গিয়ে প্রথমেই ফারহান মিয়ার সাথে আমার দেখা হয়। তিনিই আমাকে লোকটার কাছে নিয়ে যান। হবিগঞ্জ চৌধুরী বাজারস্থ নূরুল হেরা মসজিদের পাশে ছোট্ট একটা গলির ভিতর দিয়ে গিয়ে ফারহান মিয়াদের বিল্ডিংয়ের নিচতলা জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে লোকটা। লোকটাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। ফারহান মিয়াকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম লোকটা পানীয় জাতীয় খাবার বেশি খায়। তাই পাশর্^বর্তী দোকান থেকে একটা ম্যাংগু জুস আর সাথে কিছু ড্রাই কেক কিনে দিলাম। কিন্তু লোকটার আশপাশের অবস্থায় এতটাই নোংরা ছিল যে কোনভাবেই লোকটার কাছে যাওয়া যাচ্ছিল না। তখন লোকটাই বলে উঠল ‘আমার পাশে উড়াইয়া মার না কেনে’। শেষে লোকটার কথামত আমি জুসের বোতল আর ড্রাই কেকের প্যাকেট ছুড়ে দিলাম। আসার সময় আবারও জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম কি। তখন লোকটা বলল- তার নাম জীবন মিয়া। বাড়ি কোথায়? বলল- এখানেই। তারপর আর কোন কথাই সে বলল না।
ফারহান মিয়া আরও জানালেন যে, তিনি ডাক্তার সৈয়দ এম আবরার জাবেরের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন লোকটার চিকিৎসার ব্যাপারে। ডাক্তার জাবের বলেছেন, যদি লোকটাকে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া যায় তাহলে চিকিৎসার দায়িত্ব তিনি নিবেন।
করোনাভাইরাসের কারণে সারাদেশ লকডাউন হয়ে যাওয়ায় এমন হাজারো জীবন মিয়া অলিতে গলিতে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর ও সরকারের দায়িত্বশীলসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের নিজ নিজ জায়গায় থেকে তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে আহবান জানিয়েছেন তাসনুভা শামীম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আয়ারল্যান্ড প্রবাসী মোঃ সাগর আহমেদ শামীম। যতদিন লকডাউন চলবে ততদিন যেন স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের এলাকার মানসিক প্রতিবন্ধীদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখেন।
উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বর মাসে তাসনুভা শামীম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আয়ারল্যান্ড প্রবাসী মোঃ সাগর আহমেদ শামীম সীমিত সময়ের জন্য দেশে এসেছিলেন। তখন তিনি নিজেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে মানসিক প্রতিবন্ধীদের খুঁজে বের করে তাদের চিকিৎসা এবং খাবারের ব্যবস্থা করে দেন। দেশে থাকাকালীন সময়ে তিনি নিজেই প্রতিবন্ধীদের কাছে খাবার পৌঁছে দিতেন।