স্বজনদের আহাজারি ॥ এতিম হয়ে পড়া রিপনের সন্তানদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত

লেবাননে নিহত হবিগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের শ্রমিক মোজাম্মেল মিয়া ও রিপন মিয়ার লাশ ২৫ দিন পর বাড়িতে

এসএম সুরুজ আলী ॥ লেবাননে নিহত হবিগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের শ্রমিক মোজাম্মেল মিয়া ও রিপন মিয়ার লাশ ২৫ দিন পর বাড়িতে এসে পৌছেছে। শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টায় লেবানন থেকে কফিনে করে একটি ফ্লাইটে ঢাকা হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তজার্তিক বিমানবন্দরে নিহতদের লাশ পৌছলে তাদের স্বজনরা রিসিভ করেন। গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টায় ঢাকা থেকে এ্যাম্বুলেন্সযোগে লাশ ২টি বাড়িতে পৌছলে শেষ বারের মত দেখার জন্য তাদের স্বজনসহ এলাকার লোকজন বাড়িতে ভিড় জমান। এ সময় স্বজনদের কান্নায় এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠে। সকাল ৯টার দিকে জানাজার নামাজ শেষে গোবিন্দপুর কবরস্থানে নিহতদের লাশ দাফন করা হয়। নিহতরা হলেন- গোবিন্দপুর গ্রামের সিদ্দিক আলীর ছেলে রিপন মিয়া (৩৫) ও একই গ্রামের আফসর উদ্দিনের ছেলে মোজাম্মেল মিয়া (৩৫)।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে গোবিন্দপুর গ্রামে প্রবেশের সময় দেখা যায় রাস্তার পাশের কবরস্থানে দু’জনকে পৃথক কবরে দাফন করা হয়েছে। কবরস্থানের কিছু দূরেই নিহতদের বাড়ি। প্রথমে নিহত মোজাম্মেল মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মা জাহেদা খাতুন ঘরের বারান্দায় বসে ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে কান্না করছেন। সাংবাদিক দেখার পর তিনিসহ তার অনেক আত্মীয় স্বজন এগিয়ে আসেন। এ সময় মোজাম্মেলের মা জাহেদা খাতুন কান্নাজনিত কন্ঠে বলেন- তার ৫ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। এর মধ্যে মোজাম্মেল ৩য়। পরিবারের দরিদ্রতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দু’বছর পূর্বে লেবাননে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় তাকে জমি ইজারা ঋণ করে টাকা নিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম। এখনও সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারিনি। এ অবস্থায় ছেলেকে হারিয়েছি। কিভাবে আমার ছেলেটা মারা গেছে তা আমি সঠিকভাবে জানতে পারিনি। তিনি বলেন- এখন পরিবার পরিজন নিয়ে কিভাবে বাঁচবো। আমার পরিবারের অর্থ উপার্জনের ব্যক্তি ছিল সেই। সরকারি কোন ধরণের সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন- এখনও সরকারি কোন সহযোগিতা পাইনি। তিনি সরকারি সহযোগিতা পাওয়ার জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি কামনা করেন।
নিহত মোজাম্মেলের চাচাত ভাই লেচু মিয়া জানান, নিহত মোজাম্মেল ও রিপন মিয়া সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। তারা দু’জন লেবাননে ‘শুর’ জেলার দুর্গম ‘হারিফ’ গ্রামের লায়লা ইব্রাহীমের বাড়িতে শ্রমিকের কাজ নেন। তারা দু’জন একই রুমে থাকতেন। প্রতিদিনের ন্যায় গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে খাবার শেষে তারা দু’জন শীত নিবারণের জন্য দরজা-জানালা বন্ধ করে একটি স্টিলের বাটিতে কয়লা জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। পরের দিন ১২ ফেব্রুয়ারি সকালে তারা কাজে না গেলে তাদের মালিক এসে দেখেন রুমের দরজা-জানালা বন্ধ। এ অবস্থায় তিনি তাদের ডাকা-ডাকি করলেও তারা দরজা না খোলায় এক পর্যায়ে দরজা ভেঙ্গে খুলে দেখেন দু’জনের লাশ রুমে পড়ে রয়েছে। পরে পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির পর পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে অক্সিজেনের অভাব ও কয়লার কালো ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়েই তাদের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন- এ ভাবে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে বলে আমরা জানতে পারি। বাকিটা আল্লাহতায়লাই ভালো জানেন। তবে পরিবারটা অসহায়। সরকারি কোন সহযোগিতা পেলে পরিবারটি লাভবান হতো।
নিহত রিপন মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার পরিবারের সদস্যরা কান্নাকাটি করছেন। উঠানে তার বাবা সিদ্দিক আলীর কাছে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ায় তিনি ঘরের ভিতর গিয়ে রিপন মিয়ার ছবি নিয়ে আসেন। তিনি বলেন- রিপন মিয়া আড়াই বছর পূর্বে লেবাননে যান। এরপর সেখানের উপার্জনের টাকা দিয়ে তার পরিবার চলতো। কিন্তু হঠাৎ করে খবর আসে আমার ছেলের মৃত্যুর সংবাদ আমাদের কাছে আসে। সে নাকি কয়লার কালো ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছে। তা আমার বিশ^াস হচ্ছে না। মৃত্যুর খবর পেয়ে তার মালিকের কাছে যোগাযোগ করলে তিনি জানান কয়েকদিনের ভিতরে লাশ বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তিনি ২৫ দিন পর লাশ বাড়িতে পাঠালেন। বিমান বন্দরে লাশ রিসিভ করার পর ২৫হাজার টাকার একটি চেক দেয় বিমান কর্তৃপক্ষ। আর কোন সহযোগিতা আমরা পাইনি। তিনি বলেন- তার ১ মেয়ে ও দুই পুত্র সন্তান রয়েছে। তার বড় মেয়ে রুপা আক্তার এবার ১০ম শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে। আর বড় ছেলে নিয়াজ ৭ম শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে। ছোট ছেলের বয়স আড়াই বছর। তাদের সংসারটা এখন কিভাবে চলবে। তিনি সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
রিপনের মা হামিদা খাতুন জানান, এ ভাবে আমার ছেলেটা মারা যাবে সেটা আমার বিশ^াস হচ্ছে না। আমার মনে হয়, আমার ছেলেকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। না হলে লাশ পাঠাতে এতোদিন লাগবে কেন। তিনি তার ছেলের মৃত্যুর জন্য তার মালিককে দায়ী করেন। রিপনের মেয়ে রুপা আক্তার জানান, ১২ জানুয়ারি আমরা সংবাদ পাই আব্বা ও মোজাম্মেল ভাই মারা গেছেন। এ সময় যে আমার উপর যেন আসমান ভেঙ্গে পড়ে। কিছুতেই বিশ^াস হচ্ছিল না আব্বা মারা গেছেন। যখন আব্বার আর মোজাম্মেল ভাইয়ের লাশের ভিডিও ফুটেজ দেখি তখন আমাদের বিশ^াস হয়। আব্বা মারা যাওয়ার পর আমরা দাদা, দাদুর সাথে থাকছি। তারাই এখন আমাদের ভরণ পোষন করছেন। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত এখন কি হবে সেটা মহান আল্লাহতালায়ই জানেন। তবে সরকারি সহযোগিতা পেলে হয়তো আমরা একটু ভাল চলতে পারতাম। রিপনের ছেলে নিয়াজ মিয়া জানান, তার বাবা মারা যাওয়ার পর তারা অনেকটা দু:চিন্তার মাঝে পড়ে গেছেন। তাদের এতো সুন্দর সাজানো বাগান ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। নিয়াজ বলেন- এখন আমরা কিভাবে লেখাপড়া করব। লেখাপড়ার খরচ না দিতে পারলে আমাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা লেখাপড়া করতে চাই। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি। গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ইউপি সদস্য টেনু মিয়া জানান, নিহতদের নামের তালিকা জেলা প্রশাসন নিয়েছে। আশা করি জেলা প্রশাসন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে।