হবিগঞ্জে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান

যে সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান নদী দূষণ করে তাদেরকে ১/২ লাখ টাকা জরিমানা না করে গ্রেফতারের দাবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জে পুরাতন খোয়াই নদীর চলমান উদ্ধার অভিযান ও বর্তমান অবস্থা শীর্ষক নাগরিক সংলাপে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেছেন, যে সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান নদী দূষণ করে তাদেরকে ১/২ লাখ টাকা জরিমানা করে কিছুই হবে না। তাদেরকে গ্রেফতার করতে হবে। আইনে সেই সুযোগ দেয়া আছে। আর দেশে এক বছরের মধ্যে সকল নদীর অবৈধ দখলমুক্ত করতে না পারলে জেলা প্রশাসকদেরকে জবাবদিহীতা করতে হবে। উচ্ছেদে যারা বাধা দিবে সেই দখলকারীর অন্য ভূমিও অধিগ্রহণ করে ফেলতে হবে। আর জেলা প্রশাসকরা না পারলে আমরা এসে করে দিব। প্রধানমন্ত্রী যদি আমাকে দেশের সকল জেলায় এক সপ্তাহের জন্য জেলা প্রশাসক বানিয়ে দেন তবে আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারি এক সপ্তাহের মধ্যেই সকল নদী অবৈধ দখলমুক্ত করে দিব। আর দিতে না পারলে প্রধানমন্ত্রী এবং জনগনের কাছে মাফ চাইব।
তিনি শুক্রবার সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বাপা ও খোয়াই রিভার ওয়াটার কিপারের উদ্যোগে নাগরিক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, নদী নিয়ে শতাধিক সংস্থা কাজ করছে। আমরা অচিরেই একটি হট লাইন চালু করব। প্রধানমন্ত্রীর উদারতার জন্যই নদী রক্ষা শাসন আইন হয়েছে। হাইকোর্ট থেকে বলা হয়েছে নদী দখলকারী যত ক্ষমতাবানই হোন না কেন তাকে উচ্ছেদ করতে হবে। আর নদী নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের নিরাপত্তা চাহিবামাত্র নিশ্চিত করতে হবে। আমরা রেফারেন্স রিপোর্ট অব রিভার তৈরি করেছি। ১শ’ বছর আগে নদী কেমন ছিল তা স্পার্সোর বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে স্যাটেলাইন ইমেজের মাধ্যমে নির্ধারণ করছি। পরিবেশ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কারণেই এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদারতায় আজ কমিশন হয়েছে। এই কমিশন আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। যদি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ কর্তৃপক্ষের কোন গাফিলতি পাওয়া যায় ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, নদী নালার খনন ও উন্নয়নের যে প্রকল্প গ্রহণ করা হবে তার অনুমোদন নিতে হয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে। কিন্তু হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর ২ হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তার কোন অনুমোদন নেয়া হয়নি। এমনকি কমিশনে কোন কপিও প্রদান করা হয়নি। আর রাতারাতি দুই দিনে ঘরে বসে কোন প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না। এর জন্য স্টাডি করতে হবে। একশ বছর পর কি চাহিদা হবে তাও মাথায় রাখতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এক সপ্তাহের মধ্যে হবিগঞ্জের প্রকল্প নিয়ে তিনি সবার সাথে বসবেন বলে জানান। আর প্রকল্পের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার চেয়ে বেশী হয়ে যদি ৫ হাজার কোটি টাকাও লাগে তাও বরাদ্দ হবে বলে তিনি আশ্বাস প্রদান করেন। তিনি বলেন, এর জন্য সমন্বিত স্টাডির প্রয়োজন। শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করে নদী খনন করলে এক বছরের মধ্যেই আবার তা ভরে যাবে।
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যদি যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে না পারি তাহলে বৈশি^ক উষ্ণায়নের কারণে আমরা একদিন ভেসে যাব। দেশে নদী দখলকারীর যে তালিকা করা হয়েছে তার দ্বিতীয় তালিকা তৈরির নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এই তালিকা বিল বোর্ডের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হবে। ১৮৮৫ সালে যে সিআরপিসি প্রণয়ন করা হয়েছিল সেখানে বলা হয়েছে কোন চ্যানেল বা নদীকে কোনভাবে বাধাগ্রস্থ করলে তাকে পুলিশ ধরে ফেলবে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাকে শাস্তি দিবেন। কিন্তু অদ্যাবদি এই আইনে কারও কোন সাজা হয়নি। তাহলে কেন এই আইন করা হল। আর মনে রাখতে হবে নদীর জায়গা কোনভাবেই বিক্রি এবং হস্তান্তর করা যাবে না। নদীর জায়গা আর খাস জায়গা এক নয়।
তিনি মাধবপুর উপজেলার সোনাই নদীতে নির্মিত সায়হাম ফিউচার পার্ক উচ্ছেদ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বার বার ফ্যাক্স করার পর কেনও উচ্ছেদ করা হল না তা তিনি জানতে চান। পরে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন এটি উচ্ছেদের জন্য। অন্যথায় নিজে এসে উচ্ছেদ করবেন বলে জানান। হবিগঞ্জের পুরাতন খোয়াই নদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন এর বিষয়ে তিনি বলেন, আমি নিজে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শ্রদ্ধা করি। নিজে এবং পরিবারের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কিন্তু কোথাও লেখা নেই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নদীর জমি দিতে হবে। কিন্তু কেন তাদেরকে এখানে জমি দেয়া হল। তিনি নদী ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা ৪/৫ জন মিলে না করে সবাইকে নিয়ে উন্মুক্তভাবে করার আহবান জানান। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে আগামীদিনগুলো ক্রিমিনালদের জন্য শুভ নয়।
বাপা হবিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক ইকরামুল ওয়াদুদের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেলের সঞ্চালনায় সংলাপে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাপার আজীবন সদস্য, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল। ধারণা বক্তব্য উপস্থাপন করেন তোফাজ্জল সোহেল। আলোচনায় অংশ নেন নদী বিশেষজ্ঞ এ বি এম ছিদ্দিকুর রহমান, সাজিদুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক অমিতাভ পরাগ তালুকদার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত, নদী কমিশনের প্রোগ্রামার এ আর এম খালেকুজ্জামান, প্রেসক্লাব সভাপতি ইসমাইল হোসেন, সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল, শামীম আহসান, শোয়েব চৌধুরী, মটর মালিক গ্রুপের সভাপতি ফজলুর রহমান চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মমিন, কবি তাহমিনা বেগম গিনি, অ্যাডভোকেট আলাউদ্দিন তালুকদার সাংবাদিক হাফিজুর রহমান নিয়ন, অ্যাডভোকেট শাহ ফখরুজ্জামান, ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি সামছুল হুদা, সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, হারুনুর রশীদ চৌধুরী, শাহ জালাল উদ্দিন জুয়েল।
মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশনে ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, হবিগঞ্জ শহরের পুরাতন খোয়াই নদীতে যখন উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয় তখন সবাই আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসক পরিবর্তনের পর এর গতি থমকে আছে। বিশেষ করে সরকারি স্থাপনা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। বরং এখনও সেখানে সরকারি স্থাপনা হচ্ছে। এই পুরাতন খোয়াই নদী হল বৃষ্টিপাত হলে প্রাথমিক রিজার্ভার। এটি দখল হওয়ায় এখন সামান্য বৃষ্টিতেই শহরে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। এর আগে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান পুরাতন খোয়াই নদীর করুণ অবস্থা স্বচক্ষে দেখেন এবং এই ভয়াবহ বিপর্যয় দেখে অবাক হন।
শুক্রবার রাতে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও নদী কমিশনের পানি বিশেষজ্ঞ সাজিদুর রহমান বলেন, পুরাতন খোয়াই নদীর ৫ কিলোমিটার নিয়ে যে প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে সেখানে এই নদীর পানির প্রবাহের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না রেখে আবদ্ধ পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে করে পানি নোংরা এবং দূষিত হবে। এই প্রকল্পে মাছুলিয়া অংশ এবং শেষ প্রান্তে মূল নদী থেকে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে।