সৌদি আরব থেকে চুনারুঘাটের সুমার ভিডিও বার্তা

অপর বোন খাদিজা জর্ডান থেকে আজ উঠছে বিমানে ॥ দেশে আসবে কাল
সুমার আর্তি- ‘ওরা আমার উপর অত্যাচার করে। এরার অত্যাচার আমি সহ্য করতে পারি না দেইক্কা কইছি আমি যাইমু গা। এই কথা বলায় ওরা আরও বেশি অত্যাচার করে। আমি আর পারতাছি না। তোমরা যেভাবে পারো আমারে বাঁচাও।’

আবুল কালাম আজাদ, চুনারুঘাট থেকে ॥ জর্ডানে বন্দি অবস্থায় ভিডিও বার্তা জানিয়ে উদ্ধারের একদিন পর খাদিজার অপর বোন সুমা আক্তার (২২) সৌদি আরব থেকে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে তাকে উদ্ধারের আর্তি জানিয়েছে। ভিডিও বার্তায় সে জানায়, ‘আমাকে ঘরে তালা দিয়ে রাখে, খাবার দেয় না, আমাকে উদ্ধার করুন’। সুমা আক্তার চুনারুঘাট উপজেলা মিরাশী ইউনিয়নের আমতলা গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর মরম আলীর কন্যা। তার অপর বোন খাদিজা আক্তারকে তিন দিন আগে জর্ডান দূতাবাসের মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়েছে। আজ সে এয়ার এরাবিয়া বিমানে উঠছে। দেশে এসে পৌঁছবে কাল রবিবার সকালে।
ভিডিও ও অডিও বার্তায় সুমা বলেন, ‘আমি মোছাঃ সুমা আক্তার। আমারে দালালে ভালা কথা কইয়া সৌদি পাঠাইছে। সৌদির রিয়াদ এলাকায় আমি কাজ করি। আমি আইসা দেখি ভালা না। ওরা আমার উপর অত্যাচার করে। আমি বাক্কা দিন (১ মাস ১৫দিন) হইছে আছি। এখন এরার অত্যাচার আমি সহ্য করতে পারি না দেইক্কা কইছি আমি যাইমু গা। এই কথা বলায় ওরা আরও বেশি অত্যাচার করে। এরা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। আমি আর পারতাছি না। তোমরা যেভাবে পারো আমারে বাঁচাও। এরা আমারে বাংলাদেশ পাঠাইতো চায় না। আমারে তালা দিয়া রাখে। ঠিকমত খাবার দেয় না। যখন মন চায় তখন খাবার দেয়। এমনও দিন আছে আমি পানি খেয়ে থাকি। ফোন করতে দেয় না। বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে ফোন করতে হয়। তারা আমাকে মারধর করে। মুখ চেপে ধরে। দাঁতের ব্যথায় আমি কথাও বলতে পারি না। দালালরে ফোন দিলে সে আমারে আরও ভয় দেখায়। সে বলে সাংবাদিককে বললে আমারে আর দেশের মাটিতে আনবে না। এজেন্সির কোন নাম্বার নাই। বাড়িতে ফোন দিয়া মা-বাপরে বলছি। দালাল আমার মা-বাপের ফোন ধরেনা। আমারে ভালা কামের (কাজের) কথা কইয়া পাঠাইছে দালালে। আমি আর এদের অত্যাচার সহ্য করতাম পারতাছি না। তোমরা যেভাবে পারো আমারে নেও। ’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চুনারুঘাট উপজেলার ১০নং মিরাশি ইউনিয়নের আমতলা গ্রামের দিনমজুর মহরম আলীর মেয়ে সুমা আক্তার আর্থিক অস্বচ্ছলতা দুর করার জন্য সৌদি আরবে যান। কিন্তু সেখানে গিয়েই বিপাকে পড়েন। অতিরিক্ত কাজের চাপ ও গৃহকর্তার নির্যাতনে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এই নারী।
সুমার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দেড় মাস আগে আর্থিক সহায়তা করার জন্য সৌদি আরবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সুমা। চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের যাত্রাগাঁও গ্রামের কোনাবাড়ির দরবেশ আলীর ছেলে কবির নামে এক দালালের সহযোগিতায় ঢাকার ‘এক্টিভ মেন পাওয়ার সার্ভিস’ নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবে যান তিনি। এজেন্সি থেকে বলা হয়েছিল তাকে গৃহস্থালীয় কাজে পাঠানো হচ্ছে। বেতন ধরা হয়েছিল মাসিক ২২ হাজার টাকা। কিন্তু সেখানে যাবার পর ১৫ হাজার টাকা বেতন পাবে বলে জানান কর্তৃপক্ষ। এখনও কোন বেতন হাতে পায়নি সুমা। সৌদি আরব যাওয়ার ১০দিনে মাথায় নির্যাতনের বিষয়ে সুমা তার বাবাকে জানায়। সুমার বাবা মহরম আলী তাকে ফিরে আসার জন্য দালালের সাথে যোগাযোগ করলে দালাল কবির সুমাকে বাংলাদেশে ফেরত আনতে অপারগতা প্রকাশ করে তাকে গালিগালাজ করে। ২ বছরের মধ্যে তাকে দেশে ফেরত আনা যাবে না বলেও জানায় দালাল কবির। দিনদিন সুমার উপর অত্যাচার বাড়তে থাকায় সুমার বাবা মহরম আলী আবারও কবিরের কাছে গিয়ে মেয়েকে দেশে আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করলে কবির সুমার বাবার কাছে ১ লাখ টাকা দাবি করে। এরপর থেকে দালাল কবির নানা বাহানা দেখিয়ে আসছে।
এ ব্যপারে কবিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সুমার উপর অত্যাচারের বিষয়টি আমি শুনেছি। এজেন্সির সাথে যোগাযোগও করেছি। তাকে দেশে ফেরত আনার জন্য চেষ্টা করছি। তবে টাকা চাওয়ার ব্যাপারটি তিনি অস্বীকার করেন।
সুমার বাবা মহরম আলী গত ১২ জানুয়ারি চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে একঠি লিখিত আবেদন করেন। এ বিষয়ে চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার সত্যজিত রায় দাশ জানান, বিষয়টি শোনার পর তার বাবার সাথে আলাপ করেছি এবং ভিসার সকল কাগজপত্র আমরা চেয়েছি। সুমা সৌদি আরবে আছে এটা নিশ্চিত হয়েছি। কিন্তু ভিসার কাগজপত্র ছাড়া আমরা যোগাযোগ করতে পারছি না। সে কোথায় আছে, কোন কোম্পানির মাধ্যমে গিয়েছে সেটা নিশ্চিত হতে ভিসার কাগজপত্র লাগবে। আমরা এগুলো পেলে অবশ্যই সুমার পাশে দাঁড়াবো এবং তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হবে।
এদিকে সুমার অপর বোন খাদিজা আক্তারকে একই ভাবে দালাল মাস খানেক পুর্বে জর্ডান পাঠায়। সেখানে খাদিজা নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে ভিডিও বার্তায় বিষয়টি দেশে জানায়। এ ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে এবং বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর ১৪ জানুয়ারি জর্ডানের প্রবাসী সাংবাদিক সেলিম আকাশের মাধ্যমে জর্ডান দূতাবাস খাদিজাকে উদ্ধার করে। আজ শনিবার জর্ডান দূতাবাস তাকে এয়ার এরাবিয়া এয়ার লাইন্সের একটি বিমানে তুলে দিচ্ছে। রাতে শারজা বিমানবন্দর হয়ে রবিবার সকাল ১০টায় খাদিজা দেশে এসে পৌঁছবে বলে তার পিতা মরম আলী জানিয়েছেন।