স্টাফ রিপোর্টার ॥ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শীতের সকালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির জন্য এক অসামান্য প্রাপ্তি। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদারদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালির বিজয় অর্জিত হলেও তা পূর্ণতা পায়নি। শঙ্কায় সাত কোটি বাঙালি; জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তাদের অবিসংবাদিত নেতা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। এ যেন অন্তহীন অপেক্ষা। কবে ফিরবেন মহানায়ক।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী হানাদাররা বর্বর-পৈচাশিক গণহত্যায় মেতে লাখো বাঙালির রক্তের ওপর দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। যার ডাকে বীর-বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে নিল, সেই নেতা সাড়ে নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে অন্ধকার ঘরে বন্দী। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় এলো। অথচ মহান নেতাকে কারাগার থেকে দূরে আরো দুর্গম জায়গায় সরিয়ে নেয়া হল। তবে ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি সেনা বাংলাদেশে যুদ্ধবন্দী থাকায় তাদের বাঁচাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা পাকিস্তানের জন্য সহজ ছিল না। এদিকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি এবং পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
একাত্তরের ২৪ ডিসেম্বর, একটি হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির অদূরে শিহালা পুলিশ একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো সেখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে প্রশ্ন করেন, তাকেও (ভুট্টোকে) বন্দী করা হয়েছে কিনা। জবাবে ভুট্টো বলেন, তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। কিভাবে তুমি প্রেসিডেন্ট হও, যেখানে তোমার চেয়ে নির্বাচনে আমি দ্বিগুণ আসন পেয়েছি?- হেসে জানতে চান বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো উত্তর দেন, তুমি যদি চাও তাহলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পার। দৃঢ়কণ্ঠে জাতির জনক জবাব দিয়েছিলেন, না, আমি চাই না। তবে যত দ্রুত সম্ভব আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই। বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো জানান, এজন্য যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি নেবেন, তবে তার জন্য কয়েকদিন সময় লাগবে। সে সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, কয়েক মাস আগে তার বিচারে যেসব আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন তাদের কথোপকথনে তিনি জানতে পেরেছেন ড. কামাল হোসেনও বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে বন্দী। এরপর বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ড. কামাল হোসেনকেও শিহালাতে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এসব কথোপকথনের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানান।
পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস থেকে ১৯৭২ এর ৩ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো এক গোপন টেলিগ্রামে বলা হয়, মুজিব বাইরের জগত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তিনি (মুজিব) হয়তো মনে করছিলেন, বড় একটি অংশে যুদ্ধ চলছে, হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের একটি অংশ ভারত দখলে নিয়েছে। তবে তার কোন ধারণাই ছিল না পাকিস্তানের কী করুণ পরাজয় ঘটেছে। টেলিগ্রামে আরও বলা হয়, তার চারপাশের অবস্থার পরিবর্তনে বেশ অবাক মনে হচ্ছিল মুজিবকে।
বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়, তাকে মুক্তি দেয়া হবে। ৭ জানুয়ারি তাকে লন্ডনে পাঠানো হবে। ভুট্টো এসে বঙ্গবন্ধুকে নৈশভোজের দাওয়াত দেন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন, তুমি যদি আমাদের কথা শুনতে তবে রক্তপাত এড়ানো যেতো এবং পরবর্তীতে যা কিছু ঘটেছে তাও। কিন্তু তুমি নির্মম সশস্ত্র হামলা চালিয়েছ। দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক তা ছাড়া আর কিভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে তা আমি জানি না। অবশেষে বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত এগিয়ে দেন ভুট্টো।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং তার লন্ডন যাত্রার খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালি বাধভাঙ্গা উল্লাসে মেতে উঠে। এ যেন আরেকটি স্বাধীনতার সুখ। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি গভীর রাতে যাত্রা শুরু করে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শীতের সকালে বিমানটি হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা সজল চোখে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, স্যার, আমরা আপনার জন্য প্রার্থনা করছিলাম।
বঙ্গবন্ধু ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশের কিছু সময় পরে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের ইয়ান সাদারল্যান্ড সেখানে উপস্থিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। ক্লারিজ হোটেলে বঙ্গবন্ধুর থাকার ব্যবস্থা করার কথা জানান সাদারল্যান্ড। যেখানে সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধানদের থাকার ব্যবস্থা করা হতো। বঙ্গবন্ধু একটি সাধারণ হোটেলে উঠতে চাইলেও নিরাপত্তার কারণে তাকে ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধ রাখতে হয়। ক্লারিজ হোটেলে পৌঁছে বঙ্গবন্ধু তার পরিবার, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা বললেন। তারা তখন ঢাকায় ছিলেন। হোটেলে হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করেন। যা নিয়ে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় হোটেল কর্তৃপক্ষকে। পরে স্বল্প পরিসরে একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। পশ্চিম পাকিস্তানে আটক এবং যেকোনো সময় মৃত্যুদন্ড কার্যকরের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। মনে রাখতে হবে, যে মানুষ মরতে প্রস্তুত, তাকে কেউ মেরে ফেলতে পারে না। সন্ধ্যায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু। লন্ডনে থাকা অবস্থায় টেলিফোনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও কথা বলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শক্রমে ৯ জানুয়ারি তাকে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর সামরিক বিমানে দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়। ভারতীয়রাও যে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল এই সংবাদ লন্ডনে বসেই পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ৯ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে ব্রিটিশ জেট। বিমানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলেন ড. কামাল হোসেন, তার পরিবার এবং দুই ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী ও ভেদ মারওয়া। ১০ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিমানটি দিল্লীতে অবতরণ করে। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, নেতারা, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা হিসেবে।’
এদিকে স্বাধীন বাংলাদেশে বইছে আনন্দের বন্যা। ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগানে মুখরিত আকাশ-বাতাস। তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দলে জড়ো হয় লাখো জনতা। ১০ জানুয়ারি বেলা দ্বিপ্রহর। জাতির জনক এসে পৌঁছবেন বিকেলে। অপেক্ষা সেই মহানায়কের। ৭ মার্চ যার ভাষণে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামের, ঝাঁপিয়ে পরেছিল স্বশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ পর যেন লাখো জনতার অন্তহীন প্রতিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে।
এরপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে বের হয়ে জনতার মুখোমুখি হলেন। তার ছোখ চলছল, অশ্রুসিক্ত। তার সঙ্গে কাঁদছিল উপস্থিত জনতা। সাত কোটি বাঙালির দোয়া কবুল হলে। তাদের প্রাণপুরুষ ফিরে এলেন এই বাংলায়। এরপর রেসকোর্স ময়দানে যাবার পালা। যেখান থেকে ৭ই মার্চের কালজয়ী ভাষণে বাঙালি জাতির মাঝে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের বীজবপন করে গিয়েছিলেন। এর আগে জাতির পিতাকে গার্ড অব অনার দেয়া হল।
বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ট্রাকটি ধীরগতিতে চলতে লাগল। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমান বন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানালেন। পথে প্রতিটি ছাদের ওপরে আনন্দিত মুখের প্রতিচ্ছবি। নারী, পুরুষ আর শিশুর। কিশোর-তরুণরা আশেপাশের গাছগুলোতে চড়েসেছিল এই জয়োৎসব প্রত্যক্ষ করতে। সবার মুখে ছিল একই শ্লোগান- জয় বাংলা; জয় বঙ্গবন্ধু।
১৯৭২ সালের ১০ মার্চ বিকেল পাঁচটায় রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে আবারও মনকাড়া ভাষণ দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আবেগে তার গলা ধরে আসছিল। তবে বাঙালির শ্রবণের আকাক্সক্ষার কমতি ছিল না। তিনি বললেন, আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। সশ্রদ্ধ চিত্তে সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্যে দেশ গড়ার কাজে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেন। আবারও জাতি শুনতে পেল বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রমুগ্ধ সংগ্রামী কণ্ঠ ‘জয় বাংলা’। সূত্র: সংবাদ