ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
আমার গ্রামটা খুব একটা বড় না হলেও এক্কেবারে ছোট্ট না। আমি যখন ছোট তখন গ্রামে পরিত্যক্ত একটা জমিদারি কাছারি বাড়ি ছিল, শান বাঁধানো সুন্দর একটা পুকুর সহ। তখন কোথাও চাপকল বা টিউবওয়েল ব্যবহারের প্রচলন ছিল না। গ্রামের অধিকাংশ অধিবাসী এ সুগভীর পুকুরের স্বচ্ছ পানিই খাবারের বিশুদ্ধ পানি হিসেবে ব্যবহার করতেন। শাপলা শালুকের এ সরোবরে দাদির আঁচল ধরে আমিও মাঝে মাঝে নামতাম। দাদি পানিতে খোয়াজ খিজির এবং মাল মাত্তার ভয় দেখাতেন, একা একা নামলেই পায়ে টান দিয়ে নিয়ে যাবে। বেশি দূরে না গিয়ে দাদির আঁচল ধরেই সভয়ে ডুব দিতাম। ছোট্ট সময়ের এ ভয় আজো কাটেনি। বর্ষার ভাসমান পানিতে একাকী অথবা দল বেঁধে অনেক সাঁতার কেটেছি কিন্তু গভীর পুকুরে বা আবদ্ধ জলাশয়ে নামতে এখনো ভয় পাই। মেডিক্যাল ছাত্র জীবনে কাপ্তাই লেকে একবার নামার সুযোগ হয়েছিল। স্বচ্ছ গভীর জলাশয়, দৃষ্টির অগোচরে অতল তলাভূমি। ভয় ছিল খোয়াজ খিজির বা ঐ মাল মাত্তা পায়ে ধরে ঠান মারবে কি না। এখনতো প্রায় দু’তিন যুগ ধরে গভীর অগভীর, আবদ্ধ বা ভাসমান কোন পানিতেই আর নামা হয় না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে এসবের চিন্তা ভাবনাও অবান্তর।
আগেকার দিনে যখন নলকূপ শব্দটার সঙ্গে বলতে গেলে কোন পরিচিতিই ছিল না। তখন বড় বড় দিঘি, পুকুর, গঙ্গাসাগর, রামসাগর, দুর্গাসাগর এগুলোই ছিল তৎকালীন জনকল্যাণে সৃষ্ট বিশুদ্ধ জলের একমাত্র আধার। আর এর পিছনে রয়েছে অনেক কল্প কাহিনী। দাতব্য চিকিৎসালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে পুকুর বা দিঘি খননের গুরুত্ব কোন অংশেই কম ছিল না। পানির অপর নাম জীবন। অতএব চিকিৎসা এবং শিক্ষার চেয়ে এর গুরুত্ব অনেকাংশে বেশিই ছিল। তাই পীর ওলিগণ কোথাও আস্তানা গাড়লে প্রথমেই বড় বড় দিঘি খনন করাতেন ভক্তবৃন্দের দ্বারা।
আসল কথায় আসা যাক। ঘুমুতে দেরি হলেই দাদি বাতি নিভিয়ে দিয়ে পানির ক্ষমতাধর খোয়াজ খিজির, মাল মাত্তা আর বড় বড় সিন্ধুকের কাহিনী শুরু করতেন। পুকুর বা দিঘি খনন যদিও শেষ হত পানি উঠার নাম নেই। দিন যায়, মাস যায় পানির সাক্ষাত নেই। খাসি গরু জবাই সহ নানাবিধ ভোগ প্রসাদ দেওয়ার পরও পানি উঠার লক্ষণ নেই। অতঃপর বিশিষ্টজন স্বপ্নে দেখতেন কোন সুন্দরী কুমারী মেয়ে অথবা কুমার রাজপুত্র সমতুল্য সুদর্শন নির্দিষ্ট একজনকে দান করতঃ পুকুর বা দিঘি জলে ভরে উঠবে নচেৎ নহে। জনস্বার্থে বা রাজার চাপে নির্ধারিত মা বাবা আদরের সন্তানকে নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে পুকুর বা দিঘির মাঝখানে রেখে আসতেন। ধীরে ধীরে অদৃশ্য ঝন ঝন শব্দের তালে তালে পানি উঠা শুরু হত। হাজারো জনতার কান্নার রোল আর মা বাবার সকরুণ বিলাপের মাঝখানে ধীরে ধীরে আজীবনের জন্য তলিয়ে যেত জলদেব দেবীর সেই আরাধ্য রাজকুমার/রাজকুমারী। অতঃপর কানায় কানায় ভরে উঠত জলাশয়। কোন কোন ক্ষেত্রে স্বপ্নের সুবাদে নির্দিষ্ট অমাবস্যা পূর্ণিমার রাতে মা বাবা পায়ে শিকল পরিহিত আদরের সন্তানকে দূর থেকে একটু দেখার সুযোগ পেতেন এক শর্তে যে তাকে কখনো ছোঁয়া যাবে না। আবেগের কাছে হার মেনে যে মা বাবা ছুঁয়ে ফেলতেন সঙ্গে সঙ্গে শেকলে টান শুরু হয়ে যেত। আর ঝন ঝন শব্দে শিকলের টানে চিরদিনের জন্য তলিয়ে যেত সেই সন্তান। গল্পের মাঝে মাঝে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিতাম। কাল কালান্তরের সুবিধা ভোগী জনগণ এ কাহিনী লালন করে আসছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এ সুবাদে আমিও এ কাহিনীর একজন সাক্ষী। তাই গভীর কোন জলাশয়ে নামার এ ভয় আমার আজো কাটেনি ॥