এম,এ আহমদ আজাদ, নবীগঞ্জ থেকে || নবীগঞ্জে যে কোন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব ও হতাহত থামছে না। বিগত ২৫ বছরের এনিয়ে ৪ বার গোষ্ঠীগত বড় ধরনের দ্বন্দ্ব হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক মানুষ। ২৫ বছরে খুন হয়েছেন দুই জন আহত ও পঙ্গু হয়েছেন অনেকে। এদিকে গত সোমবার সংঘাতটির সূচনা হয় স্থানীয় দুজন গণমাধ্যমকর্মীর বিরোধ থেকে। পরে তা এলাকাভিত্তিক দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জড়ানো এ সংঘাতে প্রাণ হারান ১ জন, যদিও বিভিন্ন মিডিয়ায় দুই জনের মৃত্যুর ভূয়া খবর প্রচার করা হয়। এতে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়। সংঘর্ষকালে শহরে বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় ৭জনকে আটক করা হয়েছে। এখনও কোন পক্ষ নবীগঞ্জ থানায় মামলা দেয়নি। শহরের ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটে ফারুক মিয়া তালুকদারের জানাজার নামাজ তিমিরপুর প্রাইমারী স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

প্রথম খুনের ঘটনা ঘটে ২০০১ সালে, নবীগঞ্জ শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তছকির নামে একজনকে হত্যা করা হয়, আহত হন অনেকে। এরপর দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে ২০১৪ সালে শহরের সিএনজি স্টেশন নিয়ে। তৃতীয় ঘটনা হয় ২০২৪ সালে নবীগঞ্জ শহরে রাজা কমপ্লেক্সে ভাংচুর নিয়ে এতে শতাধিক লোক আহত হয়। সর্বশেষটি ২০২৫ সালের ৭ জুলাই সোমবার সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক আহত ও একজন নিহত হয়েছে। ২৫ বছরে ব্যবধানে ঘটা এসব খুন হতাহতের নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে দৈনিক আলোকিত সকাল পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি আশাইদ আলী আশা ও হবিগঞ্জের সময় পত্রিকার প্রকাশক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সেলিম তালুকদারের মধ্যে পেশাগত ও প্রেসক্লাব নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। তাদের বিরোধ এলাকাভিত্তিক দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। শতাধিক মানুষ আহত হন। তিমিরপুর গ্রামের ফারুক তালুকদার নিহত হন সংঘর্ষে। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দোকানপাট, হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ নানা প্রতিষ্ঠান। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। জারি হয় ১৪৪ ধারা।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে নবীগঞ্জ শহরে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে থমথমে পরিবেশ। সকাল ১০টার দিকে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে কয়েকজন ব্যবসায়ী সড়ক থেকে ভাঙা দোকানের ধ্বংসাবশেষ সরাচ্ছিলেন।
এ সময় নবীগঞ্জ হাইস্কুলের সামনে মুদি ব্যবসায়ী রিন্টু দাশ বলেন, ‘আমি গরীব মানুষ, ওই ঘটনার সাথে জড়িত নই। তবু আমার ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে’।

নিহত ফারুকের চাচা সাবেক পৌর কাউন্সিলর আলাউদ্দিন বলেন, ‘এ সংঘর্ষের কারণে আমাদের গ্রামের আমার ভাতিজা ফারুক প্রাণ হারিয়েছে। এমন মৃত্যু কারও কাম্য নয়। সবাই একটু সংযত থাকলে হয়তো এ সংঘাত এড়ানো যেত।’ তিনি জানান, সংঘাত এখন দুই সম্প্রদায়ে রূপ নিয়েছে। যে কোন মুহূর্তে ভয়াবহ হতে পারে।

নবীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র ও নবীগঞ্জ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ছাবির আহমেদ চৌধুরী বলেন, সংঘর্ষে নবীগঞ্জ শহরের দেড় শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়। হাসপাতাল-ক্লিনিকও রক্ষা পায়নি। অনুমান ১৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সংঘর্ষের প্রায় এক ঘণ্টা পর ১৪৪ ধারা জারি হয়। আগে করলে হয়তো এত বড় ক্ষতি হতো না।

নবীগঞ্জ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে এখনো কেউ অভিযোগ করেননি। তবে আমরা আমাদের মতো করে আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি। এ ঘটনায় সাতজনকে আটক করা হয়েছে।’ নবীগঞ্জ থানার পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় মামলা প্রস্তুতি চলছে। সেনাবাহিনী তাদের কাছে ৭জনকে ধরে হস্তান্তর করেছে। তদন্তের স্বার্থে ৭জনের নাম বলা যাবে না।
হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার এন এম সাজেদুর রহমান বলেন, একজন মারা গেছে। আমরা তার লাশ উদ্ধার করেছি। কিন্তু আমরা এখনও আর কোন লোক মারা যায়নি।

এদিকে নবীগঞ্জে সংঘর্ষের আনমনু গ্রামের রিমন নামে আরো একজন মারা যাওয়ার খবর ফেসবুকসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রিমন মারা যাননি। তিনি সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।