গাছগাছলিতে পরিবেষ্টিত চুনারুঘাটের গাজীপুর হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিবেশ বেশ ভালো লাগল

আতাউর রহমান কানন

১৯ জুন ২০০৭, মঙ্গলবার। গত দুদিন বৃষ্টির পর আজ সকালে থেকেই রোদেলা আকাশ। সকাল ১০টায় পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী নবীগঞ্জ যাই। সেখানে ইউএনও অফিস, এসি (ল্যান্ড) অফিস, সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও থানা পরিদর্শন করি। নবীগঞ্জ থেকে বিকেল ২টায় নিজ অফিসে ফিরে আসি। বিকেল সাড়ে ৩টায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিশেষ সমন্বয় সভা করি। অতঃপর হবিগঞ্জের আতঙ্ক খোয়াই বাঁধ এলাকা পরিদর্শন যাই। নদীতে এখন ভরা যৌবন। পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে বয়ে চলছে। উজানের ত্রিপুরার আঠারমুড়া পাহাড়ে অতিবৃষ্টি না হলে বিপদের তেমন আশংকা নেই বলে আমার সঙ্গে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান। আপাতত একটা স্বস্তি নিয়ে সন্ধে ৭টায় বাসায় ফিরে আসি।
সারাদিন বৃষ্টিমুক্ত টনটনে আকাশ থাকায় চারদিকের স্যাঁতসেঁতে ভাব কেটে গেছে। পরদিনও আকাশ পরিষ্কার। ঝলমলে রোদে পৃথিবীটা হেসে ওঠে। খোয়াই নদীর পানি নিম্নমুখী হওয়ায় দুশ্চিন্তা অনেকটাই কেটে গেছে। আমি সকাল ১০টায় হীড বাংলাদেশ ও স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত যক্ষা বিষয়ক কর্মশালায় যোগদান করি। সমাজ সচেতনতার অভাবে যক্ষা রোগের বিস্তার ঘটে এবং তা নির্মূলে তাই সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে- এমন মতামতই আজকের পর্যালোচনা কর্মশালায় পরিষ্কার হয়।
২১ জুন ২০০৭, বৃহস্পতিবার। সকাল ১০টায় জেলা কারাগার পরিদর্শনে যাই। আজ আমার সাথে বেসরকারি কারা পরিদর্শকগণ উপস্থিত ছিলেন। জেলা কারাগার ব্যবস্থাপনায় সরকার দ্বারা অনুমোদিত কয়েকজন বেসরকারি পরিদর্শক রয়েছেন। প্রতি তিনমাস অন্তর তাঁদের নিয়ে সভা করার বিধান রয়েছে। আজ সেই ত্রৈমাসিক সভায় সভাপতিত্ব করি। কারাগারের পরিবেশ ও বন্দিদের সেবা প্রদান বিষয়ক আলোচনা হয়। সভা শেষে কারাগার থেকে দুপুর ১২টায় অফিসে ফিরে আসি।
আজ সন্ধ্যায় আমার সহধর্মিণী পুত্র ও কন্যাসহ হবিগঞ্জে আসে। সাথে ছেলেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ক্লাসমেট-বন্ধু বেড়াতে এসেছে।
২৩ জুন ২০০৭, শনিবার। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঢাকা থেকে আসা ছেলের বন্ধুদের নিয়ে সপরিবারে মাধবকুন্ড বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম। সেখানে রওনা হওয়ার আগে সকাল ১০টায় আমার পূর্বনির্ধারিত অফিসিয়াল প্রোগ্রাম ঘঅঞঅই এর আঞ্চলিক সম্মেলনে যোগদান করি। সেখান থেকে ফিরে সাড়ে ১১টায় আমরা মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার অন্তর্গত মাধবকুন্ডের উদ্দেশ্যে রওনা করি। বেলা দেড়টায় আমরা সেখানে পৌঁছি। পথিমধ্যে বড়লেখার দক্ষিণবাগ নবীনচন্দ্র মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় পড়ে। আমি একসময় এই বড়লেখার ইউএনও পদে চাকরিকালীন আমার পুত্র এখানে কিছুদিন পড়ালেখা করে এবং এখান থেকেই এসএসসি পরীক্ষা দেয়। এই স্কুলের কাছে এসে সে গাড়ি থামাতে বললে, গাড়ি থামে। সে তার স্মৃতিবিজড়িত স্কুলে ঢুকে হেডমাস্টার ও পরিচিত শিক্ষকদের সাথে সাক্ষাৎ করে। হেডমাস্টার সাহেব আমার সংবাদ পেয়ে গাড়ির কাছে ছুটে আসেন এবং আমাদের কুশল বিনিময় হয়। আমাদের গাড়ি আবার চলতে শুরু করে।
এ উপজেলায় আমি ২০০১-২০০৩ সালে ইউএনও হিসেবে কর্মরত ছিলাম। আমারও নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে। আমার লেখা ‘ইউএনও সাহেবের আয়না’ নামক প্রকাশিত গ্রন্থে এ উপজেলায় আমার কর্মকালীন নানা ঘটনা ও এখানের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিধৃত হয়েছে।
মাধবকুন্ড এলাকায় পৌঁছে সবাই ঝরনার কাছে গেলাম। আমি ছাড়া ওরা সবাই ঝরনার পানিতে ভিজল। ছেলে ও তার বন্ধুদের আনন্দধারার কাছে ঝরনাধারা যেন ম্লান। এক সময় তারা ঝরনার পানি থেকে উঠে আসে। আমরা সেখান থেকে ফিরে সন্নিকটের পর্যটন রেস্টুরেন্টে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করলাম। আমার সময়কার রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার আশরাফ হোসেন এখনও এখানে কর্মরত আছেন। আমাকে দেখে বেশ আপ্লুত হলেন। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আন্তরিকতার সাথে খাবার পরিবেশন করলেন। এছাড়া মূল বিলের ওপর নিজে থেকেই কিছু ডিসকাউন্টও দিলেন। আমরা ম্যানেজারকে ধন্যবাদ দিয়ে মাধবকুন্ড ত্যাগ করি এবং আমার প্রাক্তন কর্মস্থল বড়লেখার বর্তমান ইউএনও’র বাসায় যাই। ইউএনও বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ আমাদের চা-নাশতায় আপ্যায়ন করেন। অতঃপর সেখান থেকে ফিরতি পথ ধরি। পথিমধ্যে মৌলভীবাজারের ডিসির বাসভবনে ঢুকি। ডিসি আলকামা সিদ্দিকী আমার ব্যাচমেট। তাঁর জেলাধীন মাধবকুন্ডে তাঁকে না জানিয়ে বেড়ানোর কথা শুনে সে তাঁর এলোমেলো গোঁফের নিচে মিটমিটিয়ে হেসে আমাকে কিছু চিকণ কথা শোনালো। আমি শুধু হেসে বললাম, ‘দোস্ত, ছুটির দিনে তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনি। এছাড়া আমার তো পূর্ববর্তী কর্মস্থল, সব চেনাজানা।’ এরপর আমরা কিছুক্ষণ সৌহার্দ্যপূর্ণ গালগল্প করে সান্ধ্যকালীন চা-নাশতায় আপ্যায়িত হয়ে রাত ৮টায় হবিগঞ্জে ফিরে আসি।
পরদিন সকাল ১১টায় বিভাগীয় কমিশনার আজিজ হাসান অফিসিয়াল ভিজিটে হবিগঞ্জ আসেন। তাঁকে যথাযথ মর্যাদায় সালামির মাধ্যমে সার্কিট হাউজে রিসিভ করি। তিনি আমার অফিসে নবযোগদানকৃত এসপি রফিকুল ইসলাম, সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির ও আমাকে নিয়ে এক সৌজন্য সভায় মিলিত হন। অতঃপর তাঁর সম্মানে প্রদত্ত লাঞ্চে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং বিকেল তিনটায় সিলেট ফিরে যান।
২৫ জুন ২০০৭, সোমবার। সকালে অফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ কাজ করে চুনারুঘাট উপজেলার উদ্দেশে বের হই। আজ এ উপজেলায় পূর্বনির্ধারিত কয়েকটি পরিদর্শন প্রোগ্রাম রয়েছে। প্রথমে গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যাই। চেয়ারম্যান তাঁর পারিষদবর্গ নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। চুনারুঘাটের ইউএনও নাভিদ শফিউল্লাহকে সেখানে উপস্থিত পেলাম। আমার আগমন উপলক্ষে চেয়ারম্যান সাহেব এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। আমি তাঁদের সাথে মতবিনিময় করলাম। অতঃপর পরিষদের কাজকর্ম দেখে কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করি। এ ইউনিয়নের কাজকর্ম সন্তোষজনক বলে প্রতীয়মান হলো।
এরপর গাজীপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত গাজীপুর হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে যাই। গাছগাছলিতে পরিবেষ্টিত প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশ বেশ ভালো লাগল। আমি কয়েকটি ক্লাশে ঢুকে পড়ার মান যাচাই করি। মান মোটামুটি। অধ্যক্ষের কক্ষে বসে পরিদর্শন বহিতে একটা নোট দিয়ে সেখান থেকে সাড়ে ১২টায় বাল্লা সীমান্ত এলাকা দর্শনে যাই। হবিগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত খোয়াই নদী এই বাল্লা পয়েন্টেই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ওপারে ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই শহর দেখলাম। খোয়াই নদীর পানি এখন বিপদসীমার নিচ দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। এখান দিয়ে দুদেশের লোকজনের যাতায়াত আছে বিধায় এখানে একটি ইমিগ্রেশন অফিস রয়েছে। আর আছে সীমান্ত চেকপোস্ট। আমি এ পর্যায়ে বিডিআর (পরে বিজিবি নামকরণ হয়)-এর সীমান্ত চেকপোস্ট দর্শনে যাই। আমাকে চেকপোস্টের দায়িত্বরত কর্মকর্তা রিসিভ করলেন। সেখানে কিছুক্ষণ বসে চোরাচালান প্রতিরোধ অভিযান ও অন্যান্য বিষয়ে খোঁজখবর নিই। চেকপোস্ট থেকে হবিগঞ্জ ফেরার পথে মিরাশী ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঢুকি। প্রোগ্রামের বাইরে আকস্মিকভাবে দর্শনে এসে এ অফিসের সবাইকে অফিসে উপস্থিত পাই। এ অফিসের কাজের কিছু খোঁজখবর নিই এবং সাথে থাকা ইউএনও’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিকেল আড়াইটায় সদরদপ্তরে ফিরে আসি।
পরের দিন সকাল ১০টায় আমার স্ত্রী-কন্যা-পুত্র ও পুত্রের বন্ধুরা একসাথে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে। ওরা চলে যাওয়ায় বাসাটি আবার ফাঁকা হয়ে যায়! আমি অফিসে গিয়ে আন্তর্জাতিক মাদক দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত র‌্যালি ও আলোচনা সভায় যোগদান করি। এরপর সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাক্ষাৎ ও অফিসের কাজকর্ম সেরে বিকেল সাড়ে ৫টায় বাসায় ফিরে আসি।
সন্ধ্যা ৭টায় টেনিস ক্লাবের বার্ষিক সাধারণ সভায় যোগদান করি। সেখানে আজ ক্লাবের নতুন কমিটি গঠন হয়। অতঃপর এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত ডিনার শেষে রাত ১০টায় বাসায় ফিরে আসি। (চলবে…)