হবিগঞ্জের এক ব্যবসায়ীসহ বৈধ পথে আমদানীকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন
স্টাফ রিপোর্টার ॥ মোটর সাইকেল উৎপাদনের নামে বাংলাদেশে রাজস্ব ফাঁকির মহোৎসব চলছে। এতে করে সরকারের শতকোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছে। একটি দেশের উন্নয়নের অক্সিজেন হচ্ছে রাজস্ব। আর এই রাজস্ব ফাঁকির মহোৎসবে নেমেছে বাংলাদেশের মোটরসাইকেল উৎপাদিত কোম্পানীগুলো। বাংলাদেশে মোটর সাইকেল উৎপাদনের সাথে জড়িত অনেক কোম্পানী খোলা মাল (সিকেডি) রাজস্ব সুবিধা নিয়ে বাস্তবে সম্পূর্ণ সংযুক্ত অবস্থায় মালামাল আমদানি করে আসছে। বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থার নজরে এলে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু চালান আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ রয়েছে একই অবস্থায় আরও বেশ কিছু কন্টেইনার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যা আমদানিকারকরা ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে খালাস করার ব্যাপক চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি এসিআই মোটরস লিঃ রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকার মাল আমদানি করে। বিষয়টি অবহিত হয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা অভিযান চালিয়ে তা আটক করতে সক্ষম হয়।
বিশ^স্ত সূত্রে জানা যায়, ওই কোম্পানীর আরও বেশ কিছু কন্টেইনার শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ আটক করেছে। শুধু তাই নয় এসিআই মোটরস মোটরসাইকেল ছাড়াও উক্ত প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য মালামাল আমদানি করতে শুল্ক ফাঁকির পায়তারা করছে। সিবিইউ মোটরসাইকেল আমদানির ক্ষেত্রে বৈধ আমদানিকারকরা এইচএস কোডের (৮৭১১-২০১১) মাধ্যমে ১৫৩% রাজস্ব সরকারকে প্রদান করে মালামাল খালাস করছেন। অপরদিকে, মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারিং এর নামে পার্টস্ এন্ড কম্পোনেন্টস এর নামে স্বল্প রাজস্বের এইচএস কোডের মাধ্যমে মালামাল খালাস করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। যারা অসাধু উপায়ে চেসিসসহ যাবতীয় মালামাল বিদেশ থেকে আমদানি করে সরকারের হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন তাদের রোষানলের শিকার হচ্ছেন বৈধ পথে মালামাল আমদানীকারকরা। সরকার কোম্পানীগুলোকে দেশে মোটরসাইকেল তৈরী, ম্যানুফ্যাকচারিং ও ফ্যাক্টরী স্থাপনে উৎসাহিত করতে রাজস্ব কমিয়ে বিশেষ সুবিধা প্রদান করে। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল এতে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা রাতারাতি মুনাফা অর্জনের হীন উদ্দেশ্যে অসৎ পন্থা অবলম্বন করে। বাস্তবে যে সকল কোম্পানী মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারিং এর দাবিদার তাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানী ছাড়া অন্যদের চেসিস বানানোর কোন সক্ষমতা নেই। অভিযোগকারীদের দাবি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সরেজমিনে তদন্ত করলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। যেখানে সরকারের হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির প্রশ্ন জড়িত, সেখানে অতি দ্রুত সুষ্টু তদন্তের দাবি অভিযোগকারীদের।
প্রসঙ্গত, কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে যন্ত্রাংশ আমদানির ঘোষণা দিয়ে সিকেডি মোটরসাইকেল এনে সাড়ে ৮ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে টিভিএস বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ওই চালানের পণ্য গোপনে খালাসও করে ফেলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অনুসন্ধানে বিষয়টি ধরা পড়ে। এ ঘটনায় কাস্টমস আইন অনুযায়ী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বেনাপোল কাস্টম।
বেনাপোল কাস্টম হাউস সূত্রে জানা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্দেশে তিন সদস্যের একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গত ১২ আগস্ট বেনাপোল কাস্টম হাউসে তদন্ত চালায়। তদন্তে ৮ কোটি ৩০ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া যায়।
কাস্টমে জমা দেয়া শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের চিঠিতে বলা হয়, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স শামছুর রহমান ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কাগজপত্র জাল করে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য চালানগুলো খালাস করেছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, মোটরসাইকেলের সঠিক এইচএস কোড-৮৭১১.১০২১ (টিটিআই) যার ডিউটি-৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশের পরিবর্তে এইচএস কোড ৮৭১৪.১০৯০ (টিটিআই)- যার ডিউটি ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। শুল্কায়নপূর্বক ২৮টি পণ্য চালানে ৮ কোটি ৩০ লাখ ৩ হাজার ৪৪ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়। এলসি, এলসিএ ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট ও কায়িক পরীক্ষার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় প্রকৃত ইনভয়েস জাল করে সিকেডি (কমপ্লিট) মোটর সাইকেলকে পার্টস অব মোটরসাইকেল ঘোষণা দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে। আমদানিকারকের দাখিল করা এলসিএ পণ্য চালানের বিবরণে রয়েছে- টিভিএস রেডিঅন ১১০ সিসি ইএস এমসিওয়াই পার্টস অ্যান্ড কম্পোনেন্টস ইন সিকেডি। কিন্তু কাস্টমসের অ্যাসাইকোডা ওয়ার্ল্ডে পাওয়া যায় ভিন্ন। প্যাকিং লিস্টে চালানের নাম পার্টস অব কম্পোনেন্টস অব টিভিএস ব্রান্ড মোটরসাইকেল টিবিএস রেডিঅন ১১০ সিসি। কাস্টমের পক্ষ থেকে বারবার রাজস্ব ফাঁকির অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দেয়ার কথা বলা হলেও জমা না দিয়ে বরং উল্টো সময় নেয়া হচ্ছে। মোটর সাইকেলের এসব চালান কোনো ফিজিক্যালি পরীক্ষা না করেই গোপনে খালাস দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার আজিজুর রহমান রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, দাবিনামা জারি করে ইতোমধ্যে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে চিঠি দেয়া হয়েছে। অভিযুক্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স শামসুর রহমানের মালিক শামসুুর রহমানকে ফাঁকি দেয়া রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারের টাকা জমা না দিলে লাইসেন্স বাতিলসহ তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মবিনুল কবির জানান, আমদানি ডকুমেন্টস জালিয়াতি করে ৮ কোটি ৩০ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা দুঃসাহসিক দুর্নীতি। বড় ধরনের শুল্ক ফাঁকির ঘটনাটি শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারাই উদঘাটন করেছেন। রাজস্ব ফাঁকির টাকা পরিশোধ না করলে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
হবিগঞ্জ শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী টাউন হল রোডস্থ এ.আর প্লাজা’র স্বত্ত্বাধিকারী মোঃ আব্দুর রহমানের পুত্র মোঃ মাহবুবুর রহমান জানান, তিনি ঢাকায় আলীজা মার্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবসা করে আসছেন। তিনি সরকারের সকল নীতিমালা অনুসরণ করে ভ্যাট, ট্যাক্স পরিশোধ করে বৈধ পথে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করছেন। কিন্তু যারা অবৈধ উপায়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করছেন তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নকল পণ্য আমদানির মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাদেরকে হয়রানি করছেন। ফলে তারা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই তিনি তদন্ত সাপেক্ষে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধ উপায়ে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে যারা ব্যবসা করছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।