জালাল আহমেদ
সামরিক শাসকরা নৈতিকভাবে দুর্বল হবার কারণে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ এর সুযোগ নিয়েছে
নির্দেশনা মতে ১১ জানুয়ারী ১৯৮৫ অপরাহ্ণে বাংলাদেশ পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টার (বিপিএটিসি) সাভারে রিপোর্ট করি। বিপিএটিসি তখন একটি নতুন প্রতিষ্ঠান। এর আগে প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে স্টাফ ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (এসটিআই), সিভিল অফিসার ট্রেনিং একাডেমী (কোটা), ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন (নিপা)’র কথা উল্লেখ করেছি। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠান ছিল এডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাফ কলেজ (এএসসি) যা বর্তমান গণভবনে অবস্থিত ছিল। এই চারটি প্রতিষ্ঠানকে এক করে ১৯৮৪ সালে বিপিএটিসি প্রতিষ্ঠা করা হয়। যে প্রকল্পের অধীনে বিপিএটিসি স্থাপিত হয় তাঁর প্রকল্প পরিচালক ছিলেন হোসেন তওফিক ইমাম, স্বনামখ্যাত এইচ টি ইমাম। ১৯৮৪ সালে প্রথম বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়, আমরা ছিলাম দ্বিতীয় ব্যাচ। ২৬ ডিসেম্বর ১৯৮৪ তারিখের চিঠিতে ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচ থেকে আমাদের ৬৪ জনকে প্রশিক্ষণে ডাকা হয়। কেউ কেউ যোগদান না করায় তাঁদের স্থলাভিষিক্ত কর্মকর্তাদের ডাকা হয়। মূল চিঠিতে উল্লিখিত সংখ্যা অনুযায়ী আমরা ৬৪ জনই প্রশিক্ষণে অংশ নেই। আসার আগেই ৩০ ডিসেম্বর ১৯৮৪ কোর্স পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে একটি চিঠি দিয়েছিলেন যা আমাদের প্রস্তুতিতে সহায়ক হয়েছিল।
বিপিএটিসি’র মেকশিফট রিসেপশনে আমাদের রিসিভ করে পূর্ব-বরাদ্দকৃত কক্ষে পৌঁছে দেয়া হয়। ডরমিটরির কক্ষগুলো ছিল দুই শয্যা বিশিষ্ট কিন্তু বাথরুম-টয়লেট পাশের কক্ষের সংগে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হতো। আমার রুমমেট ছিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব পদ থেকে অবসরে যাওয়া নিরীক্ষা ক্যাডারের Quazi Kazi Shofiqul Azam। তাঁর সংগে এই রুমমেট এর সম্পর্ক সব সময়েই অটুট ছিল। বাথরুমমেট ছিল প্রশাসন ক্যাডারের আবু তাহের ও নিরীক্ষা ক্যাডারের Ekram Ahmed। ইকরাম আহমেদ এর মুদ্রাদোষ ছিল, সে বিভিন্ন দেশ ও সময়ের মুদ্রা জমাতো। আমার ধারণা এতোদিনে তাঁর সংগ্রহ দেশ সেরা। অধুনা ইকরাম নজরুল বিশেষজ্ঞ হিসাবেও খ্যাত।
বিপিএটিসি তখনো নির্মাণাধীন, এমনকি একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, সব ডরমিটরী, করিডোরসমূহ, খেলার মাঠ, ইনডোর বা আউটডোর কিছুই প্রস্তুত ছিল না। ফলে আমাদের ক্লাশ হতো একটা ডাইনিং রুমে। ডরমিটরী পুরোপুরি প্রস্তুত বা করিডোর সম্পূর্ণ না হওয়াতে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে খেলাধুলা ও সাঁতারের জন্য দীর্ঘ পথ হেঁটে আমাদের যেতে হতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে আমাদের ফ্যাকাল্টি ছিল সম্ভাব্য সর্বোত্তম। রেক্টর ছিলেন ডক্টর শেখ মকসুদ আলী, একসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক, ১৯৫৯ ব্যাচের সিএসপি। এমডিএসরা ছিলেন ১৯৬৫ ব্যাচের ড. হারুন অর রশিদ, ১৯৬৬ ব্যাচের ড. এটিএম শামসুল হুদা ১৯৬৭ ব্যাচের ড. আকবর আলী খান, ড. এম এ জলিল এর মতো দক্ষ আমলা ও প্রশিক্ষকবৃন্দ।
প্রশিক্ষণে তাত্ত্বিক বিষয় ছিল তিনটি: ক) বাংলাদেশ পরিচিতি খ) লোক প্রশাসন গ) অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এছাড়া ছিল বিভিন্ন রুলস, রেগুলেশনস এবং প্রসিডিওরস সম্পর্কে প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ।
তিন সপ্তাহ গ্রামে থেকে সরেজমিনে জরিপ এবং গবেষণা করে গ্রামীণ জীবনের যে কোন সমস্যা নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখার বিষয় ছিল। চিঠিতে বলা ছিল যে নিজেদের খাবার মেস কমিটির মাধ্যমে নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে হবে, কেন্দ্র শুধু সহযোগিতা করবে। তাই ১২ জানুয়ারী প্রথম দিন থেকেই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল মেস কমিটি গঠন করা।
সময়টা ১৯৮৫, দেশে সামরিক শাসন এবং সামরিক শাসকরা নৈতিকভাবে দুর্বল হবার কারণে পদ্ধতি হিসাবে তাদের অবৈধ অর্জনকে ভাগাভাগি করতে পছন্দ করেন। ফলে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষও এর সুযোগ নেবার চেষ্টা করছে। তখন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ২৬ ক্যাডার এক হয়ে প্রশাসন ক্যাডারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ট্রেড ইউনিয়ন সুলভ এক আন্দোলনে লিপ্ত ছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল প্রকৃচি, প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক এই তিন পেশাজীবী সমিতি। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন, ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ কৃষিবিদ সমিতি। অবাক করা ব্যাপার হলো বিভিন্ন পেশাজীবি ক্যাডারের সদস্যবৃন্দও এ সকল পেশাজীবি সংগঠনের সদস্য ছিল।
এই আন্দোলনের প্রভাব এসে পড়লো আমাদের মেস কমিটি গঠনে। প্রেসিডেন্ট মেস কমিটি (পিএমসি) ও ট্রেজারার মেস কমিটি (টিএমসি) এই মূল দুই পদে প্রশাসন ক্যাডারকে বাদ দিয়ে কমিটি গঠনের একটা চেষ্টা হলো। প্রশিক্ষণে আমরা প্রশাসন: প্রশাসন এর ছিলাম ১০ জন, প্রশাসন: খাদ্য এর ৩ জন এবং হিসাবরক্ষণ ও নিরীক্ষা ক্যাডারের ১৮ জন। এই ৩১ ভোট নিশ্চিত হবার পর হিসাবরক্ষণ ও নিরীক্ষা ক্যাডারের Wazir Fateh কে প্রেসিডেন্ট ও আমাকে ট্রেজারার করে কমিটি গঠিত হয় এবং তা ফ্লোরে অনুমোদিত হয়। আন্তঃক্যাডার মনোমালিন্য বা প্রতিযোগিতার সঙ্গে আমার তখনই প্রথম কার্যকর পরিচয় হলো।
তখনো সাভার বাজার এই ৬৪ জনের দৈনন্দিন কেনাকাটার জন্য যথেষ্ট ছিল না বিধায় আমি কেন্দ্রের মাইক্রোবাসে করে সপ্তাহে দুই দিন ঢাকা নিউমার্কেট কাঁচাবাজার থেকে বাজার করে নিয়ে যেতাম। আমার প্রেসিডেন্ট ফাতেহ মীরপুর টেকনিক্যালে নেমে যেতো “হোনেওয়ালী” ভাবীর সঙ্গে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ব্যাঙ্ক ম্যানেজমেন্টে (বিআইবিএম) দেখা করার জন্য। ভাবী ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাঙ্কে কর্মরত এবং পরবর্তীতে উচ্চপদ থেকে অবসরে গিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগত জীবনে কাঁচাবাজার করতে নিরুৎসাহী হলেও পরবর্তীতেও আমাকে এমন প্রশিক্ষণে মেস কমিটির দায়িত্ব নিতে হয়েছে।