জালাল আহমেদ
আব্বা ছিলেন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট ॥ ১০ মাস চাকুরী করার পর পদত্যাগ করে নিজের পুরনো আইন পেশায় ফিরে আসেন
আমি যেহেতু সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ থেকে এনডিসি বা নেজারত ডেপুটি কালেক্টর তাই গাড়ি চালক, মালিক শ্রমিক মোটামুটি সবাই আমাকে চিনতো। আমি শ্রমিকদের একসংগে জড়ো করতে পারলাম, সেখানে একটি গোলঘর ছিল, গোলঘরে একটু উঁচুতে দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের উদ্দেশ্য করে এক উদ্বুদ্ধকারী বক্তৃতা দিলাম। নিজের চাকুরী বাঁচিয়ে সেনাকর্মকর্তার আচরণ ও সম্ভাব্য ব্যবস্থা সম্পর্কেও বলে তাদের গাড়ি চালাতে রাজী করালাম। ছাত্র হিসেবে আমার যে মানসিক গঠন তাও আমার বক্তৃতার শব্দ চয়নে আমাকে সাহায্য করেছিল। আমি সুবক্তা নই, কিন্তু একজন সিভিল সার্ভেন্ট বা আমলার অন্যতম গুণ হলো জন-বক্তৃতা বা পাবলিক স্পিকিং। এতে ভালো করতে হলে রীতিমত প্র্যাকটিস করতে হয় এবং একই সঙ্গে তত্ত্ব ও তথ্য হালনাগাদ রাখতে হয়। আমার আম্মা বলতেন, “কথার আছে শতেক বাণী, যদি কথা কইতে জানি!” যাই হোক আকস্মিক এই মোটর শ্রমিক ধর্মঘট অল্পায়াসে মোকাবেলায় জেলা প্রশাসক এবং এসজেডএমএলে দুজনেই আমার উপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন।
এর মাঝে মার্চ গিয়ে এপ্রিল এলো, ৮ এপ্রিল ১৯৮৪ আমার পদায়ন হলো খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর শূন্য পদে। উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট মানে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট এবং সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটের সকল ক্ষমতা যিনি প্রয়োগ করেন। এ সকল ক্ষমতা বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর এখন বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটগণ প্রয়োগ করে থাকেন। তখন আমার বয়স ২৩ বছর ৩ মাস। ইতোমধ্যে এনডিসি’র দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের অফিসার নজরুল ইসলামকে। ম্যাজিস্ট্রেট হবার আগে নজরুল পুলিশে পরিদর্শক পদে ছিল এবং পার্বত্য এলাকাতেই কাপ্তাই ও মহালছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিল। তাকে খাগড়াছড়িতে পদায়নকালে এই তথ্য বিবেচনায় নেয়া উচিত ছিল। এনডিসি হিসেবে কয়েকটি মোটা দাগের ভুল করায় অল্পদিনের মধ্যেই তাঁকে বদলে দেয়া হল। এপ্রিল মাসেই বিসিএস ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচ এর কর্মকর্তা মোঃ গোলাম রব্বানী যোগদান করেন। তিনি কিছুদিন আগে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব হিসেবে অবসরে গিয়েছেন। রব্বানি হলেন পরবর্তী এনডিসি।
এরমাঝে আমার আব্বারও উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পদায়ন হয়েছে। বলেছিলাম যে তিনি ছিলেন আইনে স্নাতক যে কারণে ১৫ দিন প্রশিক্ষণ করেই তাঁদের ৬২ জনের বিভিন্ন জেলা সদরে পোস্টিং হয়ে যায়। আব্বা নোয়াখালীতে ৬ মাস থাকার পর ডিসেম্বর মাসে তাঁর পোস্টিং হয় উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, রাজস্থলী, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। তিনি সেখানে যোগদান করেন। তখন রাজস্থলী যাবার কোন রাস্তা ছিল না। ৪২ কিলোমিটার পায়ে হাঁটা অথবা নৌকায়। উভয় পথেই যাত্রাপথে রাত কাটানো। আর নৌকা চড়া মানে নৌকা চড়া নয়, নদীতে অল্পপানি, গ্রোত এবং র‌্যাপিডস, র‌্যাপিডসগুলো আবার পানিতে নেমে নৌকা টেনে পার করতে হয়। আব্বা একাধিকবার নৌকা করেই গিয়েছেন আর পথে পাহাড়ি গ্রামে মাচাতে রাত কাটিয়েছেন। রাজস্থলী ছোট্ট উপজেলা, মাত্র ১৪৫ বর্গ কিলোমিটার, মামলা খুব কম এবং আব্বা কাজের অভাবে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানেও একটি সেটলার্স জোন ছিল, বাংগালহালিয়াতে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন জনাব আবদুল মোবারক, ১৯৭৩ ব্যাচের অন্যতম খ্যাতনামা অফিসার, পরে নির্বাচন কমিশনার, আইন কানুনে পাকা। তিনি অনেকবারই আমাকে বলেছেন যে তাঁর আইন কানুন জানা এবং এতে আগ্রহ এসেছে মূলতঃ আব্বার সঙ্গে রাজস্থলীতে কাটানো সময়কালে। দুজনের অবসর সময়ে তাঁরা মূলতঃ আইন আলোচনাতেই সময় কাটাতেন। তখন চট্টগ্রাম এর বিভাগীয় কমিশনার জনাব আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এলেন খাগড়াছড়িতে। আমি কমিশনারকে বললাম, স্যার, আমাদের পিতা-পুত্রের কথা সবাই জানে এবং জেনেশুনে একটা পরিবারের দু’জন আরনিং মেম্বারকে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্গম দুই উপজেলায় পোস্টিং দেয়া কেমন বিচার? স্যার বললেন যে চট্টগ্রামে ফিরে গিয়ে তিনি বিষয়টা দেখবেন। আমি ত্রাণ বিভাগের রেডিও টেলিফোনে রাজস্থলীতে আব্বার সঙ্গে কথা বললাম, বিষয়টা তাঁকে জানালাম। কিন্তু ততদিনে তিনি অধৈর্য হয়ে পদত্যাগপত্র দিয়ে দিয়েছেন এবং এরপরই তিনি হবিগঞ্জে ফিরে আসেন।
আব্বা ছিলেন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং ১০ মাস চাকুরী করে পদত্যাগ করে আবার নিজের পুরনো আইন পেশায় ফিরে আসেন। পদত্যাগপত্র গ্রহণ নিয়েও এক নাটক হয়। পদত্যাগপত্র নিয়ম অনুযায়ী নথিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পর্যন্ত যাবার পর তিনি প্রশ্ন তুললেন পদত্যাগ করতে চাওয়ার পেছনে অন্য কোন কারণ আছে কি না। আসলে তিনি জানতে চাইছিলেন যে পার্বত্য এলাকায় কাজ করার সুবাদে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কোন মতানৈক্য বা বিরোধের কারণে এই পদত্যাগ কি না। এদিকে আমরা পরিবার থেকে চাচ্ছিলাম যে এটা দ্রুত গৃহীত হোক। পরে সিএমএলএ সেক্রেটারিয়েটে তখন কর্মরত, পরে মূখ্য সচিব ও বোর্ড অফ ইনভেস্টমেন্ট এর চেয়ারম্যান, আমার ছোট মামা আব্দুল গণি’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রাক্তন সিএসপি সৈয়দ আব্দুস সামাদকে অনুরোধ করতে হলো। তারপর পদত্যাগপত্র গৃহিত হয়। এতদিন খাগড়াছড়ি সদরের উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল হাশেম একই সঙ্গে পানছড়ি উপজেলার মামলাও নিষ্পত্তি করতেন। জেলা প্রশাসক এএমএম রেজা ই রাব্বী আমাকে ছাড়তে রাজী ছিলেন না। জেলা প্রশাসক আমাকে অবমুক্ত না করাতে আমিও খুশী তাই খাগড়াছড়ি জেলা সদরেই কাজ করতে থাকি।