জালাল আহমেদ
আমাদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে অস্ত্র প্রশিক্ষণও ছিল, ছিল লাইভ ফায়ারিং
বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী আমাদের উপযোগী খাবারের বিষয়েও প্রস্তুত ছিল না। তাদের প্রশিক্ষণার্থীরা ১৭ থেকে ২২ বছরের, তাঁদের খাবারের চাহিদা আর ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়স্ক প্রশিক্ষণার্থীদের খাবারের চাহিদা এক রকম ছিল না। কারো কারো জন্যতো এটা ছিল একধরণের কালচারাল শক! কারণ এখানে প্রশিক্ষণার্থীদের সবাই ছিল বিসিএস ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের, যাদের অনেকেরই বয়স ত্রিশ বছরের বেশি। তাঁদের সিভিল সার্ভিসে কাজ করার মানসিক প্রস্তুতিও ছিল না। ফলে যারা ভাতে বেশী অভ্যস্ত তাঁদের খেতে অসুবিধা হচ্ছিল, ৫/৭ বেলা পরে তাঁরা ভাতের দেখা পাচ্ছিলেন। এটাও তাঁদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।
বিএমএতে উইকএন্ড এ কোন কিছু করার ছিল না। প্রথম উইকএন্ড এ একটা দল হয়ে গেল যারা সীতাকুন্ড ভ্রমন করতে চায়। সীতাকুন্ড ভাটিয়ারী থেকে কাছে, বিখ্যাত হিন্দু তীর্থস্থান, কাছেই বাড়বকুন্ড। আমরা একই দিনে দুটো দর্শনীয় স্থান দেখে নিলাম। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপর চন্দ্রনাথ মন্দির-শিব মন্দির, শিব এখানে চন্দ্রনাথ। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বাংলা ফাল্গুন মাসে শিবচতুর্দশী মেলায় প্রচুর তীর্থযাত্রী আসেন। সকালের দিকেই আমরা সীতাকুন্ডে এলাম। আমি কালো প্যান্ট ও সাদা হাফ শার্ট পরে, ছোট একটা ব্যাগে কেডসও নিলাম সংগে। আরো অনেকের সঙ্গে বন্ধু অশস ঝধরভঁষ ওংষধস ঈযড়ফিযঁৎু স্যুট পড়ে আমাদের সঙ্গী হলেন। সীতাকুন্ড মহাসড়ক থেকে রিকশা নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে আমি জুতো খুলে কেডস পড়ে নিলাম। জুতো ওখানেই জমা রাখলাম তারপর হাজার সিঁড়ি আরোহন। পাহাড়ের অর্ধেক উচ্চতায় উঠার আগেই সাইফুল রণে ভংগ দিতে চাইলো। সে ততক্ষনে কোট বহন করে ক্লান্ত, তাঁকে বললাম কোট খুলে আমার হাতে দাও। তাই দিলো সে। মাঝপথে কিছু মন্দির আছে সেগুলো দেখে নিলাম, একটু বিশ্রামও হলো।
শীতের সময় সীতাকুন্ড, যেখানে সীতা স্নান করেছিলেন বলে কথিত, শুকনো। শুকনো সহ¯্রধারা আর সুপ্তধারাও। আমরা উঠতে থাকলাম, পেছনে, পশ্চিমে তাকালে চোখে পড়ছিল বঙ্গোপসাগর, উত্তরে তাকালে আরেকটি চূড়ায় বিরুপাক্ষ মন্দির। চন্দ্রনাথ থেকে নামার পথে অনেকে ওই পথে নামে। একপর্যায়ে সাইফুলকে ধরতে হলো তবে আমরা তাঁকে নিয়েই চূড়ায় উঠলাম। শিক্ষা হলো পাহাড়ে চড়তে হলে যতো হালকা থাকা যায়। পরের উইকএন্ড কাটালাম চট্টগ্রাম শহরে। ঘুরলাম ফয়’স লেকে, নিউমার্কেটে গিয়ে আমার স্যুট নিলাম, কমান্ড্যান্ট এর গার্ডেন পার্টিতে আনুষ্ঠানিক পোষাকে যেতে হবে। তারপরের উইকএন্ড কাটালাম আশেপাশে ঘুরে, বিএমএ’র সেই বিখ্যাত “চির উন্নত মম শির” চূড়ায় উঠলাম, গেলাম এখনকার ‘সান সেট’ পয়েন্টে।
মাঝে একদিন রাতে হলো নাইট মার্চ। নাইট মার্চ হলো ম্যাপ রিডিং এর অংশ যাতে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং দক্ষতা আছে বলে আমি মনে করতাম। আমাদেরকে আগেই টাস্ক বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল। আগেরদিন রাতে ঘরে বসে ম্যাপ দেখে নিচ্ছিলাম আর বোধহয় কিছু লিখছিলাম। অভ্যাস মতো ক্যাসেটপ্লেয়ারে গান শুনছি। কোম্পানি কমান্ডার মেজর রফিক “রাতের রোঁদে” রুমে এলেন হঠাৎ করেই। পাশে এসে জিজ্ঞেস করলেন যে গান শুনেন নাকি কাজ করেন? আমি বললাম দু’টোই। স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রশ্ন করলেন যে আমি কিভাবে ক্যাসেটপ্লেয়ার নিয়ে আসলাম। আমি জানালাম যে আমি আসার আগেই এডজ্যুট্যান্ট এর সংগে কথা বলে অনুমতি নিয়ে নিয়েছিলাম। নির্দিষ্ট দিন রাতের খাবারের পর আমাদের দলকে সংগঠিত করা হলো, কম্বল ক্যারী করতে হবে সম্ভবতঃ সবাইকেই। দলনেতা হিসেবে মেজর রফিক আমার কাছে ৪টি কম্পাস দিলেন, রাতে অন্ধকারে, কম্বলের নীচে টর্চ জ্বেলে, কম্পাস-ম্যাপ কোঅরডিনেট করে পথ খুঁজে ফিরে আসার জন্য। আমি আগেই আগ্রহী এবং আত্মবিশ্বাসী ৪ জনকে কম্পাস বিতরণ করে দিলাম। মেজর রফিক যাত্রা শুরুর আগে এসে বললেন যে কম্পাসগুলো যেন ৪ জনের মাঝে বিতরণ করি। আমি বললাম যে চারজন আগ্রহীর মাঝে আগেই তা বিতরণ করা হয়েছে তখন তিনি সঠিক উদ্যোগ বলে এর প্রশংসাও করলেন। ম্যাপে আমাদের রাস্তা ঠিক করে দেয়া হয়েছিল। আমরা ম্যাপে ল্যান্ডমার্কগুলো দেখে নিয়ে বাস্তবের সঙ্গে তা মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। মাঝে মাঝেই কম্বলের নীচে টর্চ জ্বেলে ম্যাপ মিলিয়ে নিয়ে সাফল্যের সঙ্গেই ফিরে আসলাম। ওখানকার জলিল টেক্সটাইল মিল ছিল একটা ল্যান্ডমার্ক যা এখনো মনে আছে।
ক্ষোভের যে আগুন চাপা ছিল তা একদিন বেরিয়ে এলো উইপন ট্রেনিং গ্রাউন্ড থেকে ফেরার পথে। আমাদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে অস্ত্র প্রশিক্ষনও ছিল, তার অংশ ছিল লাইভ ফায়ারিং। আমি তখন নিয়মিত শিকার করি, নিজের পয়েন্ট টুটু রাইফেল ছিল, যা এখনো আছে, ফলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ উপভোগ করতাম। ফায়ারিং বাট বা অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রাউন্ড ছিল বিএমএ’র ভেতরে, অনেক পেছনে, পাহাড়ের মাঝে। পেছনে নিরাপত্তার জন্যই উঁচু পাহাড় রেখে তা তৈরী করা। এখানে এলেই আমার পাহাড় চূড়ার দিকে চোখ যেত আর ক্যামোফ্লাজ এন্ড কনসিলমেন্ট এর ক্লাশে বলা “ওয়ান মাদার এন্ড ফাইভ সিস্টার” এর কথা মনে পড়তো। আমার সতীর্থ বন্ধুরা, Sharif As-Saber, akm Saiful Islam Chowdhury Khondaker Showkat Hossain, Jnanendra Biswas, কেউ হয়তো পাঁচ বোনের কথা বলতে পারবে, কিন্তু সবার নাম আমার মনে নাই! মাদার হল মুভমেন্ট আর সিস্টার্স হল সাইজ, শেপ, শেড, সিলুয়েট। পঞ্চম বোন এর নাম ভুলে গিয়েছি। কেউ ক্যামোফ্লাজড হতে চাইলে বা নিজেকে কনসিল করতে চাইলে এই মা-বোনদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অস্ত্র প্রশিক্ষণ এর সাব (সুবেদারস) এবং স্টাফ (আদার র্যাঙ্কস)’রা সংগত কারণেই একটু বেশি রুক্ষ এবং তাঁরা ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অভ্যস্ত, ফলে যতো না বাস্তব প্রশিক্ষণ, কথা ছিল তারচেয়ে বেশি। একদিন উইপন ট্রেনিং (ডাব্লিউ টি) গ্রাউন্ডে আমরা লাইভ ফায়ারিং করলাম। আমি তখন ফায়ারিং উপভোগ করতাম। ঐদিনও কোন সমস্যা ছিল না আর ৭.৬২ চাইনিজ রাইফেল ফায়ারিং এ আমি ভালোও করেছিলাম, যদিও লাইট মেশিন গান বার্স্ট ফায়ারিং ওয়াশ আউট হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল ফায়ারিং এক্সারসাইজের পর, ট্রেনিং স্টাফরা বললো যে ‘খোকা’ মিলছে না, ‘খোকা’ হারানো গেছে, ‘খোকা’ খুঁজতে হবে!
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com