জালাল আহমেদ
আমি নিঃসন্দেহ মনে বুঝতে পারি সাফল্যের চেয়ে সন্তুষ্টি জীবনে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ

২৬ জুলাই ১৯৭৬ এ ফল প্রকাশ হলে দেখা গেল যে আমি পেয়েছি দ্বিতীয় বিভাগ। বর্তমান সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বোর্ড নিয়ে গঠিত তৎকালীন কুমিল্লা বোর্ডে প্রথম বিভাগ পেয়েছিল ২২ বা ২৪ জন। অর্থাৎ কোন কোন বর্তমান জেলা থেকে ১৯৭৬ সালে কেউই প্রথম বিভাগ পায়নি। আমার বন্ধুদের মধ্যে ফুয়াদ এবং মেহদী’র ফলাফলও ভালো ছিল। কামাল বা পার্থ সারথি নন্দী’র ফলাফলও আশাব্যাঞ্জক হয়নি। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক ছিল আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিয়াজ এর পাশ না করা। নিয়াজ ক্লাস ফাইভ থেকে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কয়েকবছর আগে তাঁর অকাল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। সে আজীবন হবিগঞ্জ সরকারী স্কুলের পড়ুয়াদের অভিভাবক ছিল, জীবনে কোন পেশায় নিযুক্ত ছিল না, কোন সামাজিক সংগঠনে না কিন্তু তাঁর জানাজায় চিল্ড্রেন্স পার্কে কয়েক হাজার লোক হয়েছিল। স্কুল থেকে যাই বন্ধু কামালের বাসায়, কামাল এখন লন্ডনে থাকে এবং সেখানে বসে ঐদিন আমার জীবনের শেষ ধুমপান করি। কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধু, যিনি কুমিল্লা বোর্ডের মেধাতালিকায় এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম ও এইচএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন, জানালেন তাঁদের সময়ে, ১৯৭৫ সালে কুমিল্লা বোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষায় ৮ জন প্রথম বিভাগ পেয়েছিল। এখনকার জিপিএ ৫ এর প্লাবনের যুগে একথা বিশ্বাস হতে চাইবে না। তবে এই বিশ্বাস আমার ছিল যে গণিতে খারাপ হওয়া বা এসএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়া মানে জীবনের শেষ দেখে ফেলা নয়। সবারই এই ধরনের বিশ্বাসটা বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।
এসএসসি পাস করার পর নিজের শহর হবিগঞ্জেই বৃন্দাবন কলেজে ভর্তি হই। ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠিত কলেজটি তখনো সরকারী নয়। কলেজে আমাদের শিক্ষকমন্ডলী ছিলেন অত্যন্ত ভালো এবং সহযোগী। সরকারী বালিকা বিদ্যালয় থেকে যে মেয়েটি প্রথম বিভাগ পেয়েছিল, আমার বন্ধু নাসরিন হোসাইন, সেও একই ক্লাশে ছিল। ফলে বছরের শুরু থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল কয়েকজনের মাঝে। আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতার একটা জায়গা হলো যে আমি ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনে খুব একটা সিরিয়াস না যা আমাকে সব সময়ই পেছনে টেনে রেখেছে। অধিক কল্পনাপ্রবণতাও দুর্বলতার একটা অংশ ছিল। এখন জীবনের ৬০ বছরে এসে যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন দেখি এই সিরিয়াসনেসের অভাব আমার জীবনের অনেক আপাতঃ ব্যর্থতার কারণ। আবার অন্যদিকে টেনশনমুক্ত মনে জীবনকে উপভোগও করতে পেরেছি এই কারণে। এই বয়সে এসে সাফল্য এবং সন্তুষ্টি কোনটির প্রয়োজন জীবনে বেশী একথা যখন ভাবি আমি নিঃসন্দেহ মনে বুঝতে পারি যে সাফল্যের চেয়ে সন্তুষ্টি জীবনে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যাই হোক, ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে কলেজের প্রথম টার্ম পরীক্ষা হয় যাতে আমি অনায়াসে প্রথম হই এবং এর পরের সবগুলো পরীক্ষাতেও প্রথম হই। তবে সবচেয়ে বড় যে উপকারটা কলেজে হয় তা’ হল মনের চোখ খুলে যাওয়া।
অন্যান্যদের মাঝে আমাদের লজিক এর শিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী সুবীর নন্দী’র বড় ভাই তপন নন্দী ও হাফিজুর রহমান স্যার, ইতিহাস পড়াতেন আজিজুল হক স্যার, রাস্ট্রবিজ্ঞান পড়াতেন আব্দুল্লাহ স্যার, ইংরেজী সুনীল বরণ সাহা ও আব্দুল মুক্তাদীর স্যার, অর্থনীতি বিএ মজহার উদ্দিন ও আব্বাসউদ্দীন আহমেদ স্যার, বাংলা পড়াতেন অতুলনীয় আবদ আল করিম ও আহসানউল্লাহ স্যার। এছাড়াও আরো শিক্ষকগন তো ছিলেনই। আমার উপর বিশেষ করে আব্দুল্লাহ স্যারের একটা বিশাল ইতিবাচক প্রভাব ছিল। স্যার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করে আমাদের কলেজে যোগদান করেছিলেন। তিনি ছিলেন আমার জন্য বন্ধুভাবাপন্ন একজন শিক্ষক, সহজেই যার কাছে যাওয়া যেত। তিনি পোষাকে ও মননে ছিলেন আধুনিক। থাকতেন কলেজেই, কলেজ কম্পাউন্ডে মসজিদের কাছে একটা টিনশেড ঘরের একাংশে। আমি কখনো কখনো স্যারের বাসায়ও গিয়েছি মূলতঃ কথা বলতে, বই আনতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বেশ কিছু বই তিনি আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। সুপ্রকাশ রায় এর ‘বাংলার কৃষক বিদ্রোহ’ এর কথা মনে পড়ে, মেকিয়াভেলী’র প্রিন্সও স্যার এর কাছ থেকে নিয়ে পড়া। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আরো কিছু মৌলিক বই পড়তে দিয়েছিলেন তিনি। এই যে চোখ খুলে দেয়া বা চোখ খুলতে সাহায্য করা তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সব জায়গায়তো আব্দুল্লাহ স্যারদের মত স্যার থাকবেন না, সেই কাজটা নিজেকেই করতে হবে। এর কোন বয়স নাই। আমরা ৫ ভাই বোন হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে পড়েছি তবে আমি যে সময়ে কলেজে পড়েছি সে সময়ে আমার আব্বা মোঃ আব্দুর রহমান অভিভাবক প্রতিনিধি হিসেবে কলেজ গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন, সদস্য ছিলেন আমার বন্ধু সায়লা পারভীন দিপা’র আব্বা জনাব আজিজুর রহমানও। আব্বা ১৯৫৮-৫৯ সালে কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট বা ভিপিও ছিলেন।
আমার যে অভ্যাসটা ছোট বেলা থেকে ছিল তা’ ছিল ‘গোগ্রাসে পড়া’, ছাপানো যাই পেতাম পড়ে ফেলতাম। আমার ছোটবেলা কাটে চট্টগ্রামে। আমার যেটুকু মনে পড়ে, সেই ছোটবয়সে আমার আব্বা, তাই ডাকতাম আমরা, পুরনো কাগজের ফেরিওয়ালা থেকে মোটা রেজিস্ট্রার রেখে দিতেন আমি যেন ছিঁড়তে পারি। আমার অক্ষরজ্ঞান হয় দৈনিক পত্রিকা থেকে, বর্ণ শিক্ষা থেকে নয়। ফলে আমি শুরুতেই স্বরচিহ্ন ছাড়া দৈনিক পত্রিকা পড়তে শিখে যাই। আর তখন থেকেই বিভিন্ন ছড়া-ছবির বই পড়তে থাকি। আমার মাও প্রচুর ছড়া বলতেন আর মজা করে শুনতাম। ১৯৬৭ পর্যন্ত আমরা চট্টগ্রামে ছিলাম, পড়েছি জামাল খান এলাকায় সেইন্ট মেরী স্কুলে। আমার ৩০ বছর পর আমার বড় ছেলে আসিফ আহমেদ ভিক্টরও ১৯৯৪ সালে এই একই স্কুলে ভর্তি হয়। পড়ার বই এর বাইরে আমার এই পড়ার অভ্যাস সারাজীবন থেকে যায়। যখন স্কুলে বা কলেজে পড়ি তখন প্রধান দৈনিক পত্রিকা বলতেই ইত্তেফাক। আমরা মফস্বলে অন্য পত্রিকা দেখেছি খুব একটা মনে পড়ে না। ঢাকায় এসে আজাদ বা সংবাদ এর সাক্ষাৎ পাই। তবে স্বাধীনতার পর পর মৌলানা ভাসানীর হককথা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। যা বলছিলাম, পড়া লেখার অভ্যাসটা ধরে রাখি এবং মফস্বলে তখন যেটা সম্ভব ছিল, পাঠাগারে যাওয়া শুরু করি। হবিগঞ্জ শহরের অন্যতম পাঠাগার পল্লী উন্নয়ন হল (আর ডি হল, এর পুরনো নাম জেনারেল আইয়ুব খান এর বেসিক ডেমোক্রেটদের প্রশিক্ষণ এর জন্য বেসিক ডেমোক্রেসি হল বা বিডি হল)। পাঠাগারে আসা শুরু করি নবম শ্রেণী থেকে, স্কুল পাঠাগারের বইও একই সঙ্গে শেষ করতে থাকি। তখন পড়ার ক্ষেত্রে অত বাছাই করে পড়ার সুযোগ ছিল না। মূলতঃ ফিকশন পড়তাম এখন বেশীরভাগ পড়ি নন ফিকশন। এছাড়া মাসুদরানা, কুয়াশা, দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরাম আর দস্যু মোহন তো ছিলই। স্কুল শেষ করার প্রায় সমসাময়িক কালে আরডি হল লাইব্রেরীতে পড়ার মত সব বই প্রায় শেষ হয়ে আসে।