মানবতা

শাহ ফখরুজ্জামান
বধুবার রাতে আমার ফেসবুকে এবং বৃহস্পতিবার দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকায় অজ্ঞাত আহতের চিকিৎসা বিভ্রাট শীর্ষক একটি অনুভূতি প্রকাশ সূচক লেখায় ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। অনেকেই এটিকে ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। আবার টেলিফোনেও অনেকেই আলাপ করেছেন। বিশেষ করে হবিগঞ্জের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মুখলেছুর রহমান উজ্জল বিষয়টি অনেক পজিটিভভাবে দেখে আমাকে ধন্যবাদ জানান। একই সাথে অজ্ঞাত রোগীর এই চিকিৎসা বিভ্রাট নিরসনে সরকারিভাবে কিছু করার জন্য জনমত গঠনের প্রয়োজন রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন। রোটারী ক্লাব অব হবিগঞ্জ সেন্ট্রালের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট সুদীপ রায় সজল মোবাইলে অনেক প্রশংসা করেন এই কাজের। সাবেক প্রেসিডেন্ট হারুনুর রশিদ চৌধুরী ক্লাবের তহবিল থেকে আরও সহযোগিতার আশ^াস দেন। ফেসবুকে দেশ বিদেশের অনেকেই মন্তব্য করেছেন। এর মাঝে আমেরিকা থেকে আবুল কালাম মন্তব্য করেছেন ওই রোগীর সর্বশেষ কি অবস্থা তা জানার জন্য। আমারও সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য আগ্রহ ছিল। আমি বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় যখন এ্যাম্বুলেন্স চালক সোয়েবকে ফোন দেই সে জানিয়েছিল ঠিকভাবেই রোগীকে সে ভর্তি করেছে। তার জন্য কোন চিন্তা না করতে বলে। সে অনেক কষ্টের পর রাত ৪টায় হবিগঞ্জ ফিরে।
হবিগঞ্জ থেকে সিলেটে প্রেরণ করার পর যেহেতু ওসমানী মেডিকেল কলেজের মত প্রতিষ্ঠানে ওই রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে এতে করে রোগীর ভাল চিকিৎসা হবে বলেই আমি ধারণা করি। শুধু আমি নই, যারাই এই লেখা দেখেছেন তাদেরও মনে এই ধারণা জন্ম নেয়াটা স্বাভাবিক। তবে আমার মনে কিছুটা কৌতুহল ছিল। সেটি হল আসলেই কি সেখানে তার ভাল চিকিৎসা হচ্ছে? কিন্তু সেখান থেকে খবর পাওয়ারও কোন ভাল উপায় পাচ্ছিলাম না। ড্রাইভার সোয়েব ৩য় তলায় ভর্তি করেছে বললেও অনুসন্ধান করার মত কোন তথ্য ছিল না আমার কাছে। বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে কোর্টে যাওয়ার পর হাতের কাজ গুছিয়ে আরও অনেকের সাথে রওয়ানা হয়েছিলাম সিলেটে একটি বিয়ের দাওয়াতে। তখনই সিদ্ধান্ত নেই, যেহেতু সিলেটে যাব তাহলে ওই রোগীর অবস্থা জেনেই আসব। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে বিকেলে চলে যাই ওসমানীতে। ৩য় তলায় সার্জারী ও নিউরো সার্জারী ওয়ার্ডে গিয়ে দরজায় প্রবেশ করার পরই আমার চোখে পড়ে সেই অজ্ঞাত রোগীকে। এই ওয়ার্ডে এক বছর পূর্বে আমি নিজেও ভর্তি হয়েছিলাম রোগী হিসাবে। সেই ওয়ার্ডে কোন বেড না পেলেও ফ্লোরেই রাখা হয়েছে আমার রোগীকে। মাথায় এবং মুখে সেলাই দেয়া হয়েছে। ক্যাথেটার লাগানো হলেও প্র¯্রাবে ভিজে রয়েছে তার বিছানা ও সারা শরীর। কাপড় নোংরা হয়ে গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। একটি হালকা কম্বল দেয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে। অনেক ডাকাডাকি করলেও কথা বলতে পারেনি ওই রোগী। মাঝে মাঝে শব্দ করছে।
রোগীর কাছ থেকে গেলাম যেখানে নার্স এবং ডাক্তার বসা সেখানে। রোগীকে দেখে যাওয়ার অনুরোধ করলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. রেজাউল করিম আসেন আমার সাথে। তিনি ফাইল খুলে দেখেন তার স্যালাইন ও ইনজেকশন দেয়ার সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। তাৎক্ষনিক তিনি তার হাতে লাগানো ক্যানোলা দিয়ে ইনজেকশন পুশ করেন। পরে স্যালাইন লাগান। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি রোগীর কি অবস্থা? তিনি বলেন, উন্নতি হচ্ছে। তবে এক্সরে এবং সিটি স্ক্যান করলে ভাল হত। আর রোগীর সাথে কোন লোক থাকলে ভাল হত। ভাল সেবা পেলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হাসপাতালের সমাজসেবা থেকে সহযোগিতার কোন সুযোগ রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি শনিবার সকালের আগে আর পাওয়া যাবে না বলে জানান। হাসপাতালের ব্রাদার ও কর্মচারীরা ওই রোগীকে কেন পরিস্কার করছেনা বললে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেননি। এভাবে বেশ কিছু সময় থাকার পর আমার সাথে থাকা অন্যরা টেলিফোন করায় আমি সেখানে বেশী সময় থাকতে পারিনি। তবে সিলেটে থাকা আমার পরিচিত জনদেরকে বিষয়টি অবহিত করি এবং সহায়তা করার আহবান জানাই। তারা বিষয়টি দেখার আশ^াস দেন।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার সময় টেলিফোন করি যার সহায়তায় ওই রোগী সেখানে ভর্তি হতে পেরেছে সেই হবিগঞ্জের কৃতি সন্তান ও সিলেটের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. দেবপদ রায়কে। তিনি ঢাকায় একটি সভাতে থাকায় কথা বলতে পারেননি। ফোন করি হবিগঞ্জের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মুখলিছুর রহমান উজ্জলকে। এ ব্যাপারে অফিসিয়াল চ্যানেলে কিছু করা যায় কি না তার জন্য তাকে অনুরোধ করি। তিনি বিষয়টি দেখছেন বলে জানান।
দুই দিনে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে সেটি হল অজ্ঞাত অবস্থায় একজন রোগী আসলেই অসহায়। ওসমানীতে ওই রোগীর পাশের বেডেই স্বজনরা রোগীর সেবা করছে। ভাল খাবার এনে দিচ্ছে। কাপড় পরিবর্তন করছে। ঔষধ খাওয়ানোর সময় হল নার্সকে ডাকছে। সাথে করে টয়লেটে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের এক হাত দুরত্বেই অসহায় এক অজ্ঞাত রোগী মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আর যারা সেখানে কাজ করছেন তারা তাদের নির্ধারিত কাজ ও সময় শেষ করে চলে যাচ্ছেন। অজ্ঞাত যে রোগীটি সেখানে আছে তার কাপড় দেখে অনুমান হয়েছে সে অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। আর না হলে ট্রেনের ছাদে সে ভ্রমণ করত না। হায়াত থাকলে হয়ত সে সুস্থ হবে। সুস্থ হবার পর স্বজনদের ফোন নাম্বার বলতে পারবে। তখন পাশে থাকা কোন হৃদয়বান তার ফোন থেকে কল করে খবর দিবেন স্বজনকে। স্বজনরা আসার পর ভাল চিকিৎসা হবে। সে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে। তবে কোনদিন জানবে না তার পিছনের কাহিনী। কিভাবে সে ওসমানীতে গেল? আর কি নিদারুণ অবহেলা হয়েছে তার চিকিৎসায়! হয়ত শুধু মনে পড়বে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণের কথা। সেই ঘটনা সে নাই বা জানুক। আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা করি অজ্ঞাত সেই যুবক সুস্থ হয়েই যেন ফিরতে পারে তার স্বজনদের কাছে।