ডাঃ ঠাকুর ইমার্জেন্সী ডিউটিরত অবস্থায় মহিলা ওয়ার্ডে ঢুকেই ইন্সপেক্টর সাহেবকে সিস্টারদের কাছে দেখে একেবারে চড়কগাছ! যা তা বলে অপমানপূর্বক ওয়ার্ড থেকে বের করে দিল।... দিন কয়েক পর অফিসে ঢুকেই দেখি ডাঃ ঠাকুর আর ইন্সপেক্টর খোসগল্পে ব্যস্ত। তৎসঙ্গে চলছে চায়ের কাপে চুমুক। বসে বসে তখন আমার কল্পনার বীমা পরিদর্শকের সাথে সামনে থাকা পরিদর্শকের বৈশিষ্ট্যসমূহের মিল খুঁজতে লাগলাম।

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

বিভিন্ন গল্প উপন্যাসে বীমা পরিদর্শকদের সম্পর্কে অনেক উপমা পড়ার বা জানার সৌভাগ্য হয়েছে। অনেক লিখক বেশ মজা করেই উনাদের লিখায় এই বীমা পরিদর্শকদের উপস্থাপন করেছেন। ধৈর্য্য, সহনশীলতা আর পুরো চামড়ার অধিকারী বীমা পরিদর্শকদের ব্যাপারে একটা কাল্পনিক চরিত্র আমার অন্তঃস্থলে পূর্ব থেকেই আসন গেড়েছিল।
১৯৮৮ সাল। জেলা সদর হাসপাতালে আমি তখন বহির্বিভাগের একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা। আমারই বাম পার্শ্বে অন্য টেবিলে ডাঃ ঠাকুর বসত, যে শিক্ষা জীবনে আমার এক বছরের অনুজ এবং নিঃসন্দেহে মেধাবী ছেলে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ও বিলেতের বড় ডিগ্রী নিয়ে দাপটের সাথে আজ বিভাগীয় শহরে প্র্যাকটিস করে চলেছে।
একজন নূতন ডাক বীমা পরিদর্শক জেলা শহরে পদায়ন হওয়ার পর আমার এখানে মাঝে মাঝে আসতে শুরু করলেন। শিক্ষিত বিনয়ী ভদ্রলোক এবং কখনো খারাপ মেজাজে দেখেছি বলে মনে হয় না। কিছু দিন যাওয়ার পর একদিন অনেকগুলো কাগজপত্র নিয়ে আসলেন যে কিছু দস্তখত দিতে হবে, এগুলো উনার ক্লায়েন্টেদের মেডিক্যাল সার্টিফিকেট। তেমন জটিল কিছু নয়, মাসের শেষে সরকারিভাবে প্রায় হাজার খানেক টাকার বিল পাওয়া যাবে। ঐ সময়ে হাজার টাকার মূল্যমান ভাল লাগার মতনই ছিল। মাস কয়েক যাওয়ার পর পরিদর্শক সাহেব কাগজপত্র নিয়ে ফাঁক ফোকরে আমার বাসায় আসা যাওয়া শুরু করলেন। সৌজন্যতায় মাঝে মধ্যে ছোটখাটো আপ্যায়ন পর্বও শুরু হল।
একদিন উনি বললেন, স্যার আপনি একটা বীমা খুলে ফেলুন। আপনার সার্টিফিকেটের বিলের টাকার অংশ বিশেষ থেকেই তা পরিশোধ হয়ে যাবে। আমার কল্পনার বীমা ইন্সপেক্টরের সঙ্গে উনাকে মিলাতে লাগলাম।
বীমা সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা এবং অভিজ্ঞতা পূর্ব থেকেই ছিল। বললাম এসব জিনিস দু’এক বছর পর আর চালানো হয় না, পরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তামাদি হয়ে যায়। আর আমার এত ধৈর্য্যও নাই। কিন্তু ভদ্রলোক নাছোড় বান্দা! বললেন, “অসুবিধা নেই, আপনি না চালালে আমি এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় আপনার টাকা সুদাসলে তুলে দিয়ে যাব।”
খাতির এবং চশম মিলিয়ে একটা বীমা খুলতে বাধ্য হলাম। যতটুকু মনে পড়ে মাস কয়েক পর আমার কোমলমতি স্ত্রীর নামেও একখানা বীমা খোলা হয়েছিল।
ব্যাপার সেটা নয়। ইস্পাত কঠিন পার্শ্ববর্তী আমার সহকর্মী ডাঃ ঠাকুর ঐ ভদ্রলোককে মোটেই সহ্য করতে পারতো না। পরিদর্শক সাহেব আমার এখানে আসলেই ডাঃ ঠাকুর গুরুগম্ভীর হয়ে যেত। ইতিমধ্যে কোনদিন ইন্সপেক্টর সাহেবকে ওর পাশে বসতে দেখিনি। জেনেছি আমার অনুপস্থিতিতে চেষ্টা করেও ইন্সপেক্টর সাহেব বিফলকাম হয়েছেন।
এরি মাঝে ইন্সপেক্টর সাহেব সিস্টারদের সাথেও বেশ খাতির জমিয়ে ফেলেছেন। এমনকি দু’এক জন বীমার খাতা খুলতে আমার মত ভুল করেননি।
একদা রাত আট/নটায় ডাঃ ঠাকুর ইমার্জেন্সী ডিউটিরত অবস্থায় মহিলা ওয়ার্ডে ঢুকেই ইন্সপেক্টর সাহেবকে সিস্টারদের কাছে দেখে একেবারে চড়কগাছ! যা তা বলে অপমান পূর্বক ওয়ার্ড থেকে বের করে দিল।
পরদিন সকালে আমাকে জানাল এই বেটা ইন্সপেক্টর আর কোনদিন আমাদের রুমে আসবে না। মনে আছে আমি তখন চুপ করেই ছিলাম। বেশ কিছুদিন পর একদিন সকালে অফিসে ঢুকতেই ডাঃ ঠাকুর বললো, বসুন কথা আছে।
বলতে লাগল -“কাল বিশেষ কাজে প্রধান ডাকঘরে গিয়েছিলাম, প্রধান সড়কে রিকশা থেকে নামতেই বীমা ইন্সপেক্টর আমাকে উনার রুম থেকে দেখে দৌঁড়ে আসলেন। জোর করে ধরে নিয়ে নিজের রুমে বসালেন। অধিনস্থকে ডেকে স্বল্প সময়ে আমার কাজ সেরে দিলেন। অতঃপর হাল্কা আপ্যায়নও। ভাই, আমিতো রীতিমত লজ্জিত।”
একটু মুচকি হাসলাম। মনে মনে ভাবলাম ‘ঠাকুর, এই ইন্সপেক্টর তোমাকে দিয়ে একদিন বীমার হিসাবও খুলবে।’
দিন কয়েক পর, সকালে অফিসে ঢুকেই দেখি ডাঃ ঠাকুর আর ইন্সপেক্টর খোসগল্পে ব্যস্ত। তৎসঙ্গে চলছে চায়ের কাপে চুমুক।
বসে বসে তখন আমার কল্পনার বীমা পরিদর্শকের সাথে সামনে থাকা পরিদর্শকের বৈশিষ্ট্যসমূহের মিল খুঁজতে লাগলাম। শতভাগ না হলেও কেন জানি অনেকটাই মিলে গেল ॥