
বীর মুক্তিযোদ্ধারা ডিসি অফিস থেকে মরা খোয়াই নদীর খাস জলাশয় বন্দোবস্ত নিয়ে অবৈধভাবে বাড়িঘর তুলেছেন
একসময় যে খোয়াই নদীর কারণে শহরবাসী কাঁদত, আজ সেই খোয়াই নদী নিজেই কাঁদে। তাঁর সেই বোবা কান্না শহরবাসী আর শুনতে পান না। অথচ খোয়াই নদীর এই মরা অংশ হতে পারত হবিগঞ্জ শহরের প্রধানতম সৌন্দর্য্যের স্থান
আতাউর রহমান কানন
৪ জুলাই ২০০৮, শুক্রবার। আকাশটা সকাল থেকেই সারাদিন মেঘে ভারি ঢাকা ছিল। মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে আষাঢ়ের বৃষ্টিও ঝরে। আজ হবিগঞ্জের ইসকন মন্দিরের রথ যাত্রার মেলা। বিকেল তিনটায় প্রধান অতিথি হিসেবে আগের বছরের ন্যায় এবারও আমাকেই রথটান অনুষ্ঠানে যেতে হয়। এ উপলক্ষ্যে সকাল ১০টায় ঢাকা থেকে আমার চাকরির ব্যাচমেট, উপসচিব ইসকনপন্থী ইতিরানী পোদ্দারসহ কয়েকজন আমার বাসায় আসেন। ইতিরানী ও আমি কুমিল্লায় প্রথম শিক্ষানবিস হিসেবে যোগদান করে একসাথে দুবছর চাকরি করেছি। তখনকার ইতিরানীকে আজ অন্য জগতের বাসিন্দা মনে হল। পরনে আটপৌরে সাধারণ সুতির শাড়ি, গলায় পুতির মালা আর কপালজুড়ে লম্বা চন্দনের টিপ। আপ্যায়ন সেবা করতে চাইলে, করজোরে জানালেন, তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা নিরামিষাশী এবং অন্যকোথাও জল স্পর্শ করেন না। আর আজ তো উপবাসে আছেন।
৭ জুলাই ২০০৮, সোমবার। আজ সকাল থেকে একনাগাড়ে জেলা আইনশৃঙ্খলার সভাসহ মোট ১০টি মাসিক সভা করি। বিকেল ৪টায় হবিগঞ্জের বুকের ওপর স্থির মরা খোয়াই নদীর বিরোধীয় অংশ সরেজমিন পরিদর্শন করি। জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা বন্দোবস্তের নামে ওই অংশে ঘরবাড়ি তুলেছেন। আদতে তাঁরা নদীর খাস জলাশয় ডিসি অফিস থেকে বন্দোবস্ত নিয়ে সেখানের নদীর পাড় অবৈধভাবে ভরাট করে এই বাড়িঘর তুলেছেন। আমার পরিদর্শনকালে এডিসি (রেভিনিউ), ইউএনও সদর, পৌরসভার মেয়র, নির্বাহী প্রকৌশলী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ ছিলেন। এ ছাড়া প্রতিপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাগণ এবং শহরের বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। আমি তাৎক্ষণিকভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ বন্ধ করি। আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জলাশয় বন্দোবস্ত সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে পরদিন আমার অফিসে হাজির হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চলে আসি।
একসময় শহরের বুকচিরে প্রবাহিত পাহাড়ি খরস্রোতা খোয়াই নদী বর্ষায় যেমন দুকূল ভাঙতে উস্তাদ ছিল, ঠিক তেমনি প্রায় প্রতি বছরই হবিগঞ্জ শহর ভাসাত। এ থেকে মুক্তির পথ হিসেবে হবিগঞ্জ জেলা হওয়ার বেশ আগে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আজিজুর রহমানের প্রচেষ্টায় সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড উজানের মাছুলিয়া এলাকায় শহর বাইপাস লুপকাটিং প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করে। এতে শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত খোয়াইয়ের মূলধারার অংশটি মরে গিয়ে ‘মরা খোয়াই’ নাম ধারণ করে। আর এই মরা খোয়াইতে বারোমাসই পানি থাকায় তা ডিসির খাস খতিয়ানে জলমহাল হিসেবে তালিকাভুক্ত। এই জলমহাল মৎস্য চাষের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া হয়ে থাকে। কালের আবর্তে মরা খোয়াইয়ের অনেকটাই মজে ভরে গিয়েছে। আর নামে-বেনামে লিজ নিয়ে ভূয়া কাগজপত্র-দলিলাদি সৃজনের মাধ্যমে অনেকেই মালিক বনে গেছেন। একসময় যে খোয়াই নদীর কারণে শহরবাসী কাঁদত, আজ সেই খোয়াই নদী নিজেই কাঁদে। তাঁর সেই বোবা কান্না শহরবাসী আর শুনতে পান না। অথচ খোয়াইয়ের এই মরা অংশ হতে পারত হবিগঞ্জ শহরের প্রধানতম সৌন্দর্য্যের স্থান।
৯ জুলাই ২০০৮, বুধবার। আজ সকালে অফিসে গিয়ে ১১টায় আসন্ন ফল ও বৃক্ষ মেলা-২০০৮ উদ্যাপন উপলক্ষ্যে জেলা কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করি। আজ বাইরে কোনো প্রোগ্রাম না থাকায় সারাদিন অফিসে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরে আসি। সন্ধ্যার পর হতে বৃষ্টি ঝরায় টেনিস মাঠে আর যাওয়া হয় না।
বেশ কিছুদিন যাবৎ ফিওদর দস্তয়ভস্কির বিখ্যাত উপন্যাস ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ পড়ছিলাম। অল্প একটু বাকি ছিল। আজ রাতে ডিনার শেষে বিছানায় গা এলিয়ে সেটুকু পড়া শেষ করে হুমায়ূন আহমেদের ‘মিসির আলির চশমা’ বইটি ধরি। এই বইটি আমাকে টেনে গভীর রাতে নিয়ে যায়।
১১ জুলাই ২০০৮, শুক্রবার। সকাল সাড়ে ৯টায় আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত র্যালিতে অংশ নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ শেষে জেলা পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় যোগদান করি। জুমাবার হওয়ায় ১২টায় আলোচনাসভা শেষ করা হয়।
আজ রাতের টিভি সংবাদে দেখলাম- শেখ হাসিনা চোখ ও কানের চিকিৎসাজনিত কারণে কারাগার থেকে একমাসের জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়ে বিদেশ চলে যান। এতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই রাজনীতির বন্ধ দুয়ার উন্মুক্ত হওয়ার আলামত দেখছেন।
১৬ জুলাই ২০০৮, বুধবার। বিগত কয়েকটা দিন অফিস আর বিভিন্ন উপজেলায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগদান করেছি। এসব কর্মসূচির অন্যতম ছিল পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সেমিনার। আজও সকাল ১০টায় মাধবপুর উপজেলায় গিয়ে ওই সেমিনার কর্মসূচিতে যোগদান করি। অতঃপর মাধবপুর সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও আন্দিউড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় পরিদর্শন করে বেলা ১টায় চুনারুঘাটের চ-ীছড়া চা বাগানের কোম্পানি বাংলোতে যাই। সেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা, নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাখাওয়াত হোসেন (অব.) ও নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসেন আসেন। আমার সঙ্গে জেলার ভোটার তালিকা ও আইডি কার্ড প্রণয়নের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। তাঁরা মূলত সিলেট সফরে এসেছিলেন। বুড়িছোঁয়ার মতো হবিগঞ্জকে ছুঁয়ে যান। মধ্যাহ্নভোজের পর তাঁরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা করেন, আর আমিও সেখান থেকে নিজ অফিসে ফিরে আসি। (চলবে…)