(মোঃ আতাউর রহমান ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই বছর হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ছিলেন। হবিগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। তাঁর সেই ডায়েরিতে ফুটে উঠেছে হবিগঞ্জের বৈচিত্রময় চিত্র। দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার পাঠকদের জন্য তাঁর ডায়েরি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে-)
হবিগঞ্জে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আমি যৌথবাহিনী কাজে লাগাচ্ছি
মানুষের মস্তিষ্ক এমনই যে, অন্যের ভালো আচরণের চেয়ে মন্দটাই বেশি রেকর্ড করে রাখে
আতাউর রহমান কানন
১ এপ্রিল ২০০৮, মঙ্গলবার। সকাল ১০টায় নবীগঞ্জ উপজেলায় গিয়ে পূর্বনির্ধারিত ‘ইসলামের আলোকে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক অবহিতকরণ’ সভায় যোগদান করি। উপজেলার কর্মকর্তা, চেয়ারম্যান, সুধীজন, ইমাম ও ধর্মীয় শিক্ষকদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত এ সভায় বক্তব্য শুনি এবং আমার বক্তব্য পেশ করে আমি উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর অফিস পরিদর্শনে যাই। বেলা দেড়টায় নবীগঞ্জ থেকে নিজ অফিসে ফিরে আসি। অপেক্ষমান ভিজিটরদের সাক্ষাৎ ও লাঞ্চ শেষে বিকেল ৩টায় জেলা বালু মহাল কমিটির সভা করি। এবার সারাদেশে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা জোরদার করায় বালুর মূল্য নাকি সোনার দরে পৌঁছেছে! হবিগঞ্জে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আমি যৌথবাহিনী কাজে লাগাচ্ছি। কিন্তু দরপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, বৈধ বালু ব্যবসায়ীদের মধ্যেও তেমন একটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ লক্ষণ নেই। আমি আজকের সভায় পুনঃদরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত দিয়ে সভা সমাপ্ত করি।
৩ এপ্রিল ২০০৮, বৃহস্পতিবার। আজ সকাল সাড়ে ৯টায় সদর উপজেলায় গিয়ে ‘ইসলামের আলোকে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক অবহিতকরণ’ সভায় যোগদান করি। গত পরশু নবীগঞ্জ গিয়েও একইরকম সভায় যোগদান করেছিলাম। এ সভা জেলার সকল উপজেলাতেই পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং আমাকেও তাতে যোগদান করতে হচ্ছে।
আজ দেড়টায় শিক্ষা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান হবিগঞ্জ আসেন। তাঁকে সার্কিট হাউজে রিসিভ করে তাঁর সঙ্গে বৃন্দাবন সরকারি কলেজে যাই। তিনি কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদান করে বিকেলে হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে যান এবং সেখানে রাত্রিযাপন করেন। তাঁর সাথে সময় কাটিয়ে ডিনার শেষে রাত সাড়ে ১১টায় বাসায় ফিরে আসি।
৫ এপ্রিল ২০০৮, শনিবার। এ বছর আগামী ৫-৭ এপ্রিল তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হওয়ায়, আমি সে উপলক্ষ্যে গতকাল বিকেলে ঢাকার বাসায় এসে অবস্থান করি। আজ সকাল সাড়ে ৯টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সকল জেলা প্রশাসক আসন গ্রহণ করি। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নিয়ে সম্মেলন উদ্বোধন করেন। এরপর সেখানে লাঞ্চ পর্যন্ত বিভিন্ন সেশন চলে। লাঞ্চ শেষে আমরা নির্দেশিত হয়ে সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে যাই। এখানেই সম্মেলনের বিভিন্ন পর্ব চলবে। আজ বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগের উপদেষ্টা ও সচিবগণ তাঁদের জন্য নির্ধারিত পর্বে উপস্থিত হয়ে কাজকর্মের উপর আলোকপাত করেন এবং দিকনির্দেশনা দেন।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন প্রথম পর্বের পর সকাল ১০টায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা সেখানের সম্মেলনকক্ষে আসন নিই। মহামান্য রাষ্ট্রপতি যথাসময়ে এসে আমাদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে আমরা তাঁর ভাষণ শ্রবণ করি। এরপর অতিথি আপ্যায়নকক্ষে গিয়ে আপ্যায়িত হয়ে আবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এসে বিভিন্ন সেশনে অংশগ্রহণ করি। সন্ধ্যা ৬টায় সেশন শেষ হলে বাসায় ফিরে আসি।
৭ এপ্রিল ২০০৮, সোমবার। আজ সম্মেলনের তৃতীয় ও শেষ দিন। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল ২টা পর্যন্ত সম্মেলন চলে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে সম্মেলন শেষ হয়। এরপর সেখানেই লাঞ্চ করে আমরা বিদায় নিই। এবার দেশের খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে প্রথানুযায়ী জেলা প্রশাসক সম্মেলনের সমাপনীর দিন রাতের বার্ষিক ডিনার অনুষ্ঠান বাতিল করা হয় এবং আমাদের আজকের মধ্যেই স্ব স্ব কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। আমি সে অনুযায়ী রাত সাড়ে ৮টায় ঢাকা ত্যাগ করি।
৯ এপ্রিল ২০০৮, বুধবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। অফিসে কিছুক্ষণ কাজকর্ম করা পর পুলিশ সুপারসহ বাহুবল উপজেলায় যাই। সেখানে দুপুর ১২টায় ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাকি স্মিথ আসেন। তিনি বাহুবল মডেল থানা ভবনের নির্মাণের ভিত্তিফলক উদ্বোধন করেন। এ ভবনটি ব্রিটিশ অনুদানে নির্মিত হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ও সিলেটের ডিআইজি রেঞ্জও উপস্থিত থাকেন। উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে তাঁরা চলে গেলে আমি হবিগঞ্জ ফিরে আসি।
সন্ধে ৬টায় সিলেটের উদ্দেশে রওনা করি। সাড়ে ৭টায় সিলেট সার্কিট হাউজে পৌঁছে বিভাগীয় কমিশনারের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানে যোগদান করি। দেড় বছরের মাথায় তিনি বদলি হয়েছেন। আজ তাঁর বিদায় সভায় ভালো ভালো কথায় বক্তব্য দিলাম, যদিও ছুটি নিয়ে আমার প্রতি তিনি যে আচরণ করেছিলেন, তা ভেতর থেকে কই মাছের মতো ঘাই মারছিল। মানুষের মস্তিষ্ক এমনই যে, অন্যের ভালো আচরণের চেয়ে মন্দটাই বেশি রেকর্ড করে রাখে। এতে আমার আর দোষ কী! তবে বলতে দ্বিধা নেই, বেশ কিছুদিন আগে থেকেই আমার প্রতি তাঁর অবিশ্বাস্য ভালো আচরণ লক্ষ করছি। অনুষ্ঠান শেষে বিদায়ী ডিনারে যোগদান করি।
১৪ এপ্রিল ২০০৮, সোমবার। আজ পয়লা বৈশাখ। সকাল সাড়ে ৬টায় হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শিরিষতলায় বর্ণমালা খেলাঘর আয়োজিত বৈশাখবরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। সেখানে খেলাঘরের শিশুরা বর্ণিল সাজে সমবেত হয় এবং মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। সেখান থেকে সরকারি মহিলা কলেজ মাঠে গিয়ে আয়োজিত বৈশাখীমেলার উদ্বোধন করি। এখানে নানাধরনের বাঙালি ঐতিহ্যবাহী পণ্য ও খাদ্যের স্টল বসে। গুড়-খই আর পান্তা ভাতের স্টলও বাদ যায়নি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মেলা বেশ জমে ওঠে। আমি ঘণ্টাখানিক সময় এ মেলায় কাটিয়ে বাসায় ফিরে আসি।
১৬ এপ্রিল ২০০৮, বুধবার। আজ বানিয়াচং উপজেলায় বোরো মৌসুমের প্রথম ধানকাটার আনুষ্ঠানিক প্রোগ্রাম দিয়েছি। এটা আমার মস্তিষ্কপ্রসূত এ জেলায় প্রথম অনুষ্ঠান। দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ধানের উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। এ জন্য আমি বোরো মৌসুমের শুরু থেকেই বিভিন্নভাবে কৃষকদের উৎসাহ ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। সারা দেশে সারের সংকট থাকলেও আমি জেলায় সারের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও কৃষকদের সহজ প্রাপ্তিতে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছি। কৃষি বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী এ জেলায় এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই কৃষকদের মূল্যায়নসহ আরও উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রশাসনিকভাবে বানিয়াচংয়ের হাওড়ের মাঠে ধানকাটা উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিই।
আমি সকাল ১১টায় পুলিশ সুপারসহ বানিয়াচংয়ে যাই। ইউএনও নূরে আলম সিদ্দিকী আমাদের অনুষ্ঠানস্থল হাওড়ের গড়পাইড়া এলাকায় নিয়ে যান। সেখানে হাওড়ের মধ্যে সামিয়ানা খাটিয়ে ব্যানারও টাঙিয়েছেন। সে ব্যানারে আমার কাছ থেকে লিখিয়ে নেওয়া স্লোগান- ‘কৃষক আমার মাঠের গুরু, ধানকাটা হলো শুরু’ শিরোনাম করা হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে অধিকাংশই কৃষক। আমরা কৃষকের কথা শুনি ও আমন্ত্রিত অতিথিদের কথাও শুনি। এরপর তাঁদের উদ্দেশে ইউএনও, কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক, পুলিশ সুপার ও আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখি। এবার যেসব কৃষক গতবারের চেয়ে বেশি জমিতে বোরো আবাদ করেছেন, কৃষি বিভাগ কর্তৃক তাঁদের একটি তালিকা প্রণয়ন করে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিই। এরপর দলেবলে লাইন ধরে কাস্তে হাতে পাকা ধান কেটে এ বছরের ধানকাটা উদ্বোধন করি। বিকেল ৪টায় বানিয়াচং থেকে হবিগঞ্জ সদরে ফিরে আসি। পরদিন এ খবর দৈনিক প্রথম আলো-সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করে।
১৯ এপ্রিল ২০০৮, শনিবার। আজ হবিগঞ্জে কৃষি উপদেষ্টা ড. সিএস করিম আসার প্রোগ্রাম দেন। তিনি হাওড়ের বোরো ফসলের উৎপাদন সরেজমিন দেখবেন। এছাড়া আরও কয়েকটি কর্মসূচি রয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের সাথে সমন্বয় করে আমি প্রস্তুতি গ্রহণ করি। বেলা ১টায় কৃষি উপদেষ্টাকে যথারীতি সার্কিট হাউজে রিসিভ করি। লাঞ্চের পর তাঁকে নিয়ে বানিয়াচংয়ের সুবিদপুর ইউনিয়নের হাওড়ে যাই। একটি জমির পাকা ধানের ক্রপকাটিং নমুনা উৎপাদন তিনি সরেজমিন যাচাই করে দেখেন এবং গড় উৎপাদন দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। নিজেও কাস্তে হাতে ধান কাটেন। তাঁকে ৩দিন আগে আমার ধানকাটা উদ্বোধন অনুষ্ঠান সম্পর্কিত পেপারক্লিপ দেখালে, সংবাদটি তিনি দেখেছেন বলে জানান এবং আমার প্রশংসা করে ধন্যবাদ দেন। প্রশংসায় সবাই যেমন খুশি হয়, আমিও তেমন। উপদেষ্টা মহোদয় বিকেল ৪টায় হবিগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত কৃষকদের মাঝে ডিজেলের ভতুর্কির টাকা প্রদান অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। সেখানে কৃষকদের উদ্দেশে উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্য রাখেন এবং তালিকাভুক্ত গোপায়া ইউনিয়নের ১১০ জন কৃষককে ডিজেল ভর্তুকির নগদ টাকা প্রদান করেন। বিকেল ৫টায় তিনি ঢাকার উদ্দেশে হবিগঞ্জ ত্যাগ করেন। (চলবে…)