উত্তম কুমার পাল হিমেল
আজ ১৪ জানুয়ারি ২০২৫খ্রী: ২৯ পৌষ ১৪৩১ বাংলা রোজ মঙ্গলবার পৌষ সংক্রান্তি এবং উত্তরায়ণ শুরু। প্রতিমাসের শেষ দিন অর্থাৎ যে দিন মাস পূর্ণ হবে সেই দিনকে সংক্রান্তি বলা হয়। সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যাদির এক রাশি হতে অন্য রাশিতে গমন করাকেও সংক্রান্তি বলা হয়। সং+ ক্রান্তি অর্থ সঙ মানে সাজা ক্রান্তি সংক্রমণ বা গমণ করাকে বুঝায়। অর্থাৎ ভিন্ন রূপে সেজে অন্যত্র গমণ করা বা সঞ্চার হওয়াকে বুঝায়। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঢ় এই ছয় মাস উত্তরায়ণ কাল এবং শ্রাবন, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্ত্তিক, অগ্রহায়ন, পৌষ, এই ছয় মাস দক্ষিণায়ন কাল। পৌষ মাসের শেষ দিনে সূর্য উত্তরায়নের দিকে যাত্রা শুরু করে বলে একে উত্তরায়ণ সংক্রান্তিও বলা হয়। শাস্ত্রমতে মানুষের একবছর দেবতাদের একটি দিন রাতের সমান। অর্থাৎ মানুষের উত্তরায়নের ছয়মাস দেবতাদের একটি দিন এবং মানুষের দক্ষিণায়নের ছয়মাস দেবতাদের একটি রাত। রাতে মানুষ যেমন দড়জা জানালা, প্রধান ফটক বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন তেমনি দেবতাগণও রাত্রে অর্থাৎ দক্ষিণায়নে সবকিছু বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন। এসময় বাহির থেকে প্রবেশ করার সুযোগ নেই অর্থাৎ দক্ষিণায়নে দেবলোক পুরোপুরি বন্ধ থাকে। আবার দেবতাগণের রাত পৌষ সংক্রান্তির দিন শেষ হয় বলে পরবর্তি সূর্য উদয়ের ব্রহ্মমুহূর্ত থেকে দেবতাগণের দিবা শুরু হয়। উক্ত সময়ে স্বর্গবাসী ও দেবলোকের সকলের নিদ্রা ভঙ্গ হয় এবং নিত্য ভগবৎ সেবামূলক ক্রিয়াদী শুরু হতে থাকে। এই জন্য হিন্দু ধর্মাম্বলম্বীগণ ব্রহ্ম মুহূর্তে স্নান, নামযজ্ঞ, গীতাপাঠ, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটিকে আনন্দময় করে তুলেন।
অন্যদিকে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম তাঁর পিতা শান্তনু থেকে বর পেয়েছিলেন যে তিনি যখন ইচ্ছা মৃত্যুবরণ করতে পারবেন। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বীশ্ববিখ্যাত বীর, মহাপ্রজ্ঞ, সর্বত্যাগী ও জীতেন্দ্রিয় মহাপুরুষ ভীষ্মের মহাপ্রয়ানের স্মৃতির জন্য পৌষ সংক্রান্তি আরও মর্যাদাপূর্ণ হয়েছে। উল্লেখ্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরব পক্ষের চারজন সেনাপতির মধ্যে তিনিই প্রধান সেনাপতি ছিলেন। উভয় পক্ষের আঠার দিন যুদ্ধের দশম দিবসে সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বে পান্ডব পক্ষের সেনাপতি অর্জুনের শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভীষ্মদেব রথ থেকে পড়ে যান। কিন্তু তিনি মাটি স্পর্শ না করে আঠান্নদিন তীক্ষè শরশয্যায় শুয়ে উত্তরায়নের অপেক্ষা করে পৌষ সংক্রান্তির দিনে যোগবলে দেহত্যাগ করেন।
গ্রাম বাংলা সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ভোরবেলা আগুন লাগানো হয় খর ও বাঁশ দিয়ে বানানো স্তুপে। এটা মূলত পিতামহ ভীষ্মদেবের চিতার স্বরুপ। পৌষ সংক্রান্তির দিন সূর্য উত্তর মেরুতে হেলে পড়তে থাকে যার জন্য একে মকর সংক্রান্তি বা উত্তরায়ণ সংক্রান্তি বলে। শাস্ত্রমতে ভীষ্মদেব মৃত্যুর পরে ভাগবদ্ ধামে যাননি। তিনি ছিলেন দৌ মতান্তরে দ্যু নামক অষ্টবসু। যিনি মহর্ষি বশিষ্টের অভিশাপগ্রস্ত হয়ে ইহলোকে মনুষ্য হিসাবে কৃতকর্ম ভোগের জন্য জন্ম নিয়েছিলেন। তাই তাঁর পুনরায় দেবলোকে যাবার কথা। কারণ তিনি সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। দক্ষিণায়নের সময়ে দেবলোকে রাত্রি, সেই সময় সেখানকার সব কিছুই বন্ধ থাকে। ভীষ্মদেব যদি দক্ষিণায়নে দেহত্যাগ করতেন তবে তাঁকে তাঁর লোকে প্রবেশ করার জন্য বাইরে প্রতিক্ষা করতে হতো। তিনি ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন বলে ভেবে দেখলেন, দক্ষিণায়নে মহাপ্রয়ান করলে দেবলোকে গিয়ে বাইরে প্রতীক্ষা করার চেয়ে এখানে থেকে উত্তরায়নের প্রতীক্ষা করাই ভালো। কারণ এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভ হবে এবং সৎসঙ্গ হতে থাকবে। যার ফলে সকলেরই মঙ্গল হবে। দেবলোকে একলা প্রতীক্ষা করে কী হবে। এই ভেবে তিনি দক্ষিণায়নে শরীর ত্যাগ না করে উত্তরায়ণে শরীর ত্যাগ করেছিলেন। দীর্ঘ আঠান্নদিন শরশয্যায় অবস্থানের পর পৌষ সংক্রান্তির নিশান্তে পিতামহ ভীষ্মদেব যোগবলে দেহত্যাগ করে দেবলোকে গমন করেন।
৫০০০ বছর পূর্ব হতে আমরা প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তি বা উত্তরায়ণে প্রাতকালে খরকুটো জড়ো করে পিতামহ ভীষ্মদেবের প্রতীকি শবদাহ করে থাকি। অনেকে এই শবদাহকে বুড়ির ঘর বা মেড়ামেড়ির ঘর বলা কোন কোন এলাকায় ভেড়ার ঘর জ্বালানো বলে থাকেন এবং এই দিনে মাছ, মাংস আহার করে থাকেন যাহা সম্পূর্ণ অনুচিত। কারণ উত্তরায়ণ বা পৌষ সংক্রান্তি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শ্রাদ্ধ সংক্রান্ত অনুষ্ঠান। অন্যদিকে এই দিনটি এতই গুরুত্বপূর্ণ। এই দিন প্রাতঃকালে দেবলোকের সকল দেবতাগণ ও স্বর্গবাসী পূর্বপুরুষগণ নিদ্রা থেকে জাগ্রত হন। এই জন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ ব্রহ্মমুহূর্তে স্নান, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, গ্রামে নগড়ে সংকীর্তন, গীতাপাঠ, ইত্যাদি মঙ্গলজনক কাজ করে থাকেন। প্রতি বছর শাস্ত্রসম্ম¥তভাবে ভাবগাম্ভীর্যের সহিত এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন।
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com