চাষী ও ভোক্তার মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে হবিগঞ্জ শহরে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে স্থাপন করা হয় ‘চাষি বাজার’
কালীবাড়ি সংস্কার ও নির্মাণ কাজ নিয়ে সদস্যদের মধ্যে নানা মত দেখা দেয়ায় সভা মুলতবি করি
আতাউর রহমান কানন
২৭ জানুয়ারি ২০০৮, রবিবার। গত কয়েকদিন ধরে হবিগঞ্জ এলাকায় বেশ শীত পড়ছে। আধাবেলা কুয়াশার জন্য সূর্যের দেখা মেলে না। মাঘের মাঝামাঝি হাড় কাঁপুনি এ শীতে গ্রামীণ দরিদ্র জনসাধারণ বেশি কষ্ট ভোগ করছেন। আমি আমার গুদামের সব শীতবস্ত্র বিভিন্ন উপজেলায় ও পৌরসভায় প্রেরণ করেছি। আজ বিকেল আড়াইটায় নবীগঞ্জ পৌরসভা পরিদর্শনে যাই। সেখানে দরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করি। বেশ কয়েকদিন পর আজ বিকেলে সূর্যের হাসিমুখের দেখা মিলে। আমি নবীগঞ্জ থেকে সন্ধ্যে ৬টায় সদর দপ্তরে ফিরে আসি।
সন্ধ্যার পর টেনিস খেলতে গিয়ে দেখি- মাঠ আজ পোকা ও কুয়াশার দখলে। হবিগঞ্জে এত বিচিত্র ধরনের পোকা যে কোথায় জন্মে তার হদিস নির্ণয়ে গবেষণার দরকার। আর টেনিস মাঠের হ্যালোজেন লাইটের আলো ওদের বেশ প্রিয়। যদিও ‘পতঙ্গের পাখা গজায় মরিবার তরে’ প্রবাদ অনুযায়ী প্রচুর পোকা প্রতিদিন এখানে এসে আত্মাহুতি দিচ্ছে। পোকার অত্যাচারে খেলায় স্বস্তি না পেয়ে মাঠ থেকে আজ আগেভাগেই বাসায় ফিরে আসি।
৩১ জানুয়ারি ২০০৮, বৃহস্পতিবার। আজ সকাল থেকে আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। শীতের প্রকোপ কমে গেছে। আশা করি এ বছর আর বাড়বে না। আমি সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে ১০টায় জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিস কর্তৃক আয়োজিত “Stakeholder Meeting on Longterm Family Planning Methods” নামক মতবিনিময় সভায় যোগদান করি।
১২টায় নিজ অফিসকক্ষে ফিরে নানারকম কাজকর্ম আর ভিজিটরদের সাক্ষাতেই দিনটির বাকি সময় কেটে যায়।
এখন নতুন মাঠে টেনিস খেলা নিয়মিত চলছে। খেলোয়াড়দের মাঠে নামার উৎসাহও আগের চেয়ে বেড়েছে। আমিও বা তাতে কম কীসে? আজও সন্ধের পর টেনিস খেলি।
৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, রবিবার। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে অফিসে পরপর কয়েকটি সভায় সভাপতিত্ব করি। বরাবরের ন্যায় অফিসেই নামাজ এবং লাঞ্চ সারি। নানাবিধ কাজে দিন যে কোথা দিয়ে যায় টেরও পাই না। দেখতে দেখতে ডিসি পদে প্রায় দেড় বছর পার হয়ে যাচ্ছে। বদলির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে এখানেই পড়ে আছি। জানি না হবিগঞ্জের ভাত আর কতদিন খেতে হবে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল তো শুরু থেকেই আমার পেছনে লেগেই আছেন। তারাও যদি কিছু করতে পারতেন আমি একরূপ বেঁচে যেতাম, আর তারাও খুশি হতেন। কিন্তু কেন যেন তারাও পারছেন না!
৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, বৃহস্পতিবার। আজ সকালটা বেশ পরিষ্কার। কুয়াশা আর আগের মতো তেমন একটা নেই। দিগন্তজুড়ে সূর্যের সোনালি রোদ। আজ সকাল ৯টায় অফিসে গিয়েই জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটি, চোরাচালান বিরোধী টাস্কফোর্স কমিটি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটিসহ পরপর মোট ১১টি নির্ধারিত সভায় সভাপতিত্ব করি।
সন্ধে ৭টায় হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবে নজরুল একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত ‘বাংলাভাষার উৎকর্ষ সাধনে নজরুলের অবদান’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। সেমিনারে বসে জানলাম, বিশেষজ্ঞ বক্তাদের চেয়েও বেশি বিশেষজ্ঞ হলো- আমার অফিসের এডিসি মোহাম্মদ জাকীর হোসেন। নজরুলের ওপর তাঁর অসাধারণ বক্তব্য সবাইকে মুগ্ধ করে। সেমিনার শেষে রাত সাড়ে ৮টায় বাসায় ফিরে আসি।
৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, শনিবার। সকাল থেকেই বিরূপ আবহাওয়া। মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে গুড়িঁগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে। সকালে আলস্যভরা দেহে বিছানা ত্যাগ করে ফ্রেশ হয়ে নাশতা করি। ১০টায় পৌরসভার কমিশনার সামছু মিয়া জন্মনিবন্ধনকারী সঙ্গে নিয়ে আমার বাসভবনে আসেন। তাঁরা আমার জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে পৌরসভার জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করবেন। আমি আমার জন্মনিবন্ধন ফরম পূরণ করে দিই। বর্তমানে ঘটা করে সারাদেশে জন্মনিবন্ধন চলছে। সরকারি ঘোষণামতে দেশের যেকোনো এলাকার সিটি করপোরেশন, পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধন করা যাবে। এই নিবন্ধন কার্যক্রম শুরুর আগে এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে বিভিন্নভাবে কয়েক বৎসর যাবৎ নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানাবিধ প্রচারপ্রচারণা, সেমিনার ও সভা-সমাবেশ করা হয়। দেশে জন্মনিবন্ধন আইন থাকলেও নাগরিকগণ তাতে কোনো গুরুত্ব দিত না। অশিক্ষিত নাগরিক তো বয়সই বলতে পারেন না সঠিকভাবে, আর জন্ম তারিখ বলা তো দূরের কথা। আবার শিক্ষিত শ্রেণির বয়স তো সাধারণভাবে স্কুলের শিক্ষক বা কেরানি বসিয়ে দিতেন। সে জন্য তাঁদের প্রায় সকলেরই দুইটা জন্মতারিখ নিয়ে চলতে হচ্ছে।
সকাল ১১টায় কালিবাড়ি পরিচালনা কমিটির সভায় যোগদান করি। হবিগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে এই প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি অনেক জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত। মূল ভবন-সহ অনেকগুলো দালানঘর জরাজীর্ণ। এগুলোর আশু সংস্কার-নির্মাণের জন্য এই সভার আয়োজন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক কালিবাড়ি কমিটির পদাধিকার বলে সভাপতি। সভা দীর্ঘক্ষণ চলে। তবে সংস্কার-নির্মাণ কাজ নিয়ে সদস্যদের মধ্যে নানামত দেখা দেয়। এ কারণে আজ শুধু আলোচনাই হলো, তেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল না। সভা মুলতবি করে বিকেল আড়াইটায় বাসায় ফিরে আসি।
১০ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, রবিবার। সকালে কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘলা আকাশ। সেই সঙ্গে হিমেল হাওয়া। তবে দুপুরের পর থেকে আকাশ ভালো হতে থাকে। আমি সকালে যথাসময়ে অফিসে যাই। আজ পৌনে ১২টায় হবিগঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তুতকৃত ভোটার আইডি কার্ড বিতরণ করা হয়। এ উপলক্ষ্যে সেনাবাহিনীর এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন এনডিসি, পিএসসি হবিগঞ্জে আসেন। আইডি কার্ড বিতরণ শেষে তিনি আমার অফিসের সম্মেলনকক্ষে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন। সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দিকনির্দেশনা দেন। তিনি বিকেল আড়াইটায় চলে যান। সামরিক-বেসরকারি প্রশাসনের সমন্বয়ে দেশ চলছে। তবে সামরিক প্রশাসনের যে প্রাধান্য রয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলার প্রভূত উন্নতি সাধিত হলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরাই চ্যাম্পিয়ন বলে মনে হচ্ছে। তবে সরকারও বসে নেই। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নানা কর্মসূচি নিয়ে এগুচ্ছে।
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, বুধবার। সকাল ৯টায় কোর্ট স্টেশন এলাকায় বেশ ঘটা করে ‘চাষি বাজার’ উদ্বোধন করি। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে এ বাজার স্থাপিত হয়েছে। উদ্দেশ্য- চাষী ও ভোক্তার সরাসরি সংযোগ স্থাপন। এতে মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় কৃষি ভোগ্যপণ্যের দাম যেমন কমবে, তেমনি চাষীও ন্যায্যমূল্য পাবেন।
বাজার উদ্বোধন শেষে হবিগঞ্জ শহর বাইপাস রোডে খোয়াই নদীর ওপর নির্মিত কামড়াপুর নতুন ব্রিজ ও অ্যাপ্রোচ রোড উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যাই। সেখানে ছোটোখাট একটি সমাবেশের মাধ্যমে বহুদিনের প্রতীক্ষিত ব্রিজ ও অ্যাপ্রোচ রোডটি উদ্বোধন করি। এতে হবিগঞ্জ থেকে বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ ও নবীগঞ্জ উপজেলার যাতায়াত সহজতর হবে। এ রাস্তায় নবীগঞ্জ হয়ে সহজেই কম সময়ে সিলেটও যাতায়াত করা যাবে।
এদিন বেলা ১১টায় মাধবপুর উপজেলায় যাই। ইউএনও অফিস পরিদর্শন করি। থানা পরিদর্শনেরও প্রোগ্রাম দেওয়া ছিল। তাই সেখান থেকে থানায় যাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে সেন্ট্রি ও ডিউটি অফিসার ছাড়া কাউকে পাওয়া গেল না। আমি থানা থেকে বেরিয়ে চৌমুহনী ইউনিয়ন পরিষদের উদ্দেশে রওনা করি। গাড়িতে বসে এসপিকে ফোন করলাম। তিনি জানালেন, ওসি ফোর্সসহ মনতলা বাজারে একটি কাজে গেছেন। আমার কাছে জবাব সন্তোষজনক মনে হলো না। বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর এমন ঢিলেঢালা অবস্থা প্রায় সকল থানাতেই লক্ষ্য করছি। কী আর করা! সবাই তো স্বাধীন থাকতে চায়। (চলবে…)
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com