হঠাৎ চালের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সারা দেশে হইচই পড়ে যায়
‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ যেন দিনদিন কালচারে রূপ নিচ্ছে
আতাউর রহমান কানন
১ জানুয়ারি ২০০৮ মঙ্গলবার। শুরু হলো গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার আরেকটি বছর। বয়স বাড়বে আয়ু কমবে দিনান্তরে। অনেক আশা-আকাক্সক্ষা স্বপ্ন নিয়ে আগামীর পথচলা। যায় দিন ভালোর মতো যেন আসে দিন ভালো হয়- এই কামনা করছি।
এখন ভরা শীতের মৌসুম একসময় উত্তরবঙ্গে চাকরি করাকালীন শীত কাকে বলে টের পেয়েছি। পাহাড়-হাওড়-বনবনানী ঘেরা হবিগঞ্জেও কিন্তু শীত কম না। আজ নববর্ষের সকালটা শুরু হয়েছে ঘন কুয়াশার আবরণে। তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে সোনালি রোদ্দুরও ক্ষণে ক্ষণে হেসে ওঠছে। বছরের এই প্রথম দিনেই প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণের সরকারি কর্মসূচি রয়েছে। আমি সে উপলক্ষ্যে সকাল ৯টায় অফিসে ঢু মেরে ১০টায় বহুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আয়োজিত নতুন বই বিতরণ অনুষ্ঠানে যোগদান করি। সেখানে বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করে সাড়ে ১০টায় দারুচ্ছুন্নাৎ আলিয়া মাদরাসায় গিয়ে এবতেদায়ী পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ করি। বিতরণ কার্যক্রম শেষে ১১টায় নিজ অফিসে ফিরে আসি।
১২টায় দুদক চেয়ারম্যান লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী (অব.) হবিগঞ্জে আসেন। তাঁর দেওয়া পূর্ব-নির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুযায়ী কিবরিয়া পৌর মিলনায়তনে দুর্নীতি প্রতিরোধ অভিযান সংক্রান্ত মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। তিনি সে সভায় যোগদান করে দুর্নীতির বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ উল্লেখকরত এক দৃঢ়চেতা বক্তব্য রাখেন। তিনি সিলেটের উদ্দেশে চলে গেলে আমি অফিসে গিয়ে বসি। এ সময়েও অফিসে অনেকেই আমার সাথে সাক্ষাৎ করে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ জানান। এটা যেন দিনদিন কালচারে রূপ নিচ্ছে। আমি একটানা অফিস করে বিকেল সোয়া পাঁচটায় বাসায় ফিরে আসি।
৩ জানুয়ারি ২০০৮, বৃহস্পতিবার। সকাল ১০টায় মাদরাসা জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত সভায় সভাপতিত্ব করি। এরপর সকাল সাড়ে ১১টায় চালের মূল্য বৃদ্ধিসংক্রান্ত জরুরি সভায় বসি। সভায় সেনা ইউনিটের অধিনায়ক ও পুলিশ সুপারসহ ব্যবসায়ী সমিতির হর্তাকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ করে সারা দেশে চালের মূল্য বাড়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কদিন আগের ২২ টাকা কেজি মোটা চালের দাম ৩৫-৩৬ টাকায় উঠেছে। যদিও এখন আমন ধান-চালের সংগ্রহের ভরা মৌসুম। এই মূল্যবৃদ্ধিতে সারা দেশে হইচই পড়ে গেছে। মূল্য বৃদ্ধির কারণ বের করার জন্য সরকার নির্দেশ জারি করেছে।
বিকেল আড়াইটায় সাবেক সচিব মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বিসিকের একটি টিম আসে। তাঁদের সঙ্গে হবিগঞ্জ বিসিক শিল্প এলাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিনিময় সভা হয়। শিল্প এলাকায় অনেকেই প্লট নিয়ে ফেলে রেখেছেন।সেখানে এখন গরু চড়ে। বরাদ্দপ্রাপ্তরা হাঁটেনও না, পথও ছাড়েন না অবস্থা। আজকের সভায় তাঁদের চূড়ান্ত নোটিশ দিয়ে প্লট বরাদ্দ বাতিল করে নতুন করে বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
৬ জানুয়ারি ২০০৮, রবিবার। সকাল সাড়ে ৯টায় জালাল স্টেডিয়ামে গিয়ে জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ টি-২০ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট উদ্বোধন করি। হবিগঞ্জের প্রথম শ্রেণির বিভিন্ন ক্লাব এ টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। সেখান থেকে অফিসে গিয়ে সাড়ে ১১টায় বিশেষ রাজস্ব সম্মেলনে যোগদান করি। বিভাগীয় কমিশনার আজিজ হাসান উক্ত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। তিনি বেলা একটায় সভা শেষে সিলেটের উদ্দেশে রওনা করেন।
বিকেল ৩টায় জেলার সরকারি স্কুলসমূহে ভর্তি বিষয়ক প্রস্তুতি কমিটির সভায় যোগদান করি। এ জেলা শহরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধ বেশ প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়। আর তদবিরেরও কোনো শেষ নেই। আমি কোনো তদবিরের পাত্তা না দিয়ে পরীক্ষা নিয়ে মেধার ভিত্তিতে ভর্তির জন্য সিদ্ধান্ত দিই।
১০ জানুয়ারি ২০০৮, বৃহস্পতিবার। সকালে যথারীতি অফিসে যাই। আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক বছর পূর্ণ হওয়ায় দেশব্যাপী ‘পরিবর্তনের এক বছর’ নামক নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে হবিগঞ্জে প্রশাসনের সহায়তায় জেলা তথ্য অফিসের উদ্যোগে জেলার কর্মকর্তা, সুধীজন ও সাংবাদিকগণদের সমন্বয়ে এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সকাল ১১টায় ‘পরিবর্তনের এক বছর’ শীর্ষক সেমিনারে আমি প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখি। সেমিনারে সরকারের সাফল্যগাথা সফলভাবে তুলে ধরা হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা এই সেমিনার চলে।
বিকেল ৩টায় শাহজীবাজারস্থ হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান করি। সেখানে জ্বালানী সচিব মোহাম্মদ মহসিন আসেন। তিনি গ্যাসফিল্ডের ১১ নং কূপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর গ্যাস উৎপাদনের সাফল্য নিয়ে আলোচনাসভা হয়। সভা শেষে গ্যাসফিল্ডের অভ্যন্তরস্থ ফ্রুট্স ভ্যালি দর্শন করেন। তিনি বিদায় নিলে আমি সেখান থেকে সন্ধে ৬টায় বাসায় ফিরে আসি।
১২ জানুয়ারি ২০০৮, শনিবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বেলা সাড়ে ১২টায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমদ চৌধুরী হবিগঞ্জ আসেন। তিনি জেলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করেন। মধ্যাহ্নভোজের পর তিনি চলে গেলে আমি বিকেল ৩টায় নাগুড়া ফার্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত অনুদানের চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে যোগদান করি। সেখান থেকে ৫টায় বাসায় ফিরে আসি।
১৪ জানুয়ারি ২০০৮, সোমবার। সকালে অফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ কাজ করে বাহুবলের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। সেখানে পৌঁছে আমার পূর্বনির্ধারিত ভাদেশ্বর ইউনিয়ন ভূমি অফিস পরিদর্শন করি। ইউএনও এসি (ল্যাল্ড) এর দায়িত্বে থাকায় তিনি আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমি আমার রুটিন পরিদর্শন করি। রেজিস্টার ও নথিপত্র পর্যালোচনাকরত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সেখান থেকে দেড়টায় সদরদপ্তরে ফিরে আসি।
বিকেল ৫টায় অফিস থেকে জালাল স্টেডিয়ামে যাই। সেখানে জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ টি-২০ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করি। এ টুর্নামেন্টে দিগন্ত ক্রীড়াচক্র চ্যাম্পিয়ন হয় আর রানার আপ হয় শাপলা সংসদ।
রাত ৭টায় পুনর্নির্মিত টেনিস মাঠের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান করি। অনুষ্ঠানে ক্লাবের সক্রিয় সদস্য, খেলোয়াড় ও সুধীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ঝকঝকে মাঠ দেখে সবাই প্রশংসা করেন। মাঠ সংস্কার কমিটিকে ধন্যবাদ দিয়ে আগামীকাল থেকে মাঠে নামার ইচ্ছাপোষণ করে বাসায় ফিরে আসি।
১৬ জানুয়ারি ২০০৮, বুধবার। সকাল ৯টায় জেলা কারাগার পরিদর্শন করতে যাই। ঘুরেফিরে কারাগারের সব ওয়ার্ড ও রন্ধনশালা দেখি। এবার কারাগারে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। এই কেন্দ্রে দুভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলা ও আরবি শিক্ষার কার্যক্রম চলছে। অনেক নিরক্ষর বন্দি এখানে স্বাক্ষরজ্ঞান অর্জন করেছেন। অনেকে ভালোভাবেই পড়তে ও লিখতে পাড়ায় বেশ আনন্দিত। ১১টায় কারাগার পরিদর্শন শেষে নিজ অফিসে ফিরে আসি। সারাদিন অফিসের বিভিন্ন কাজকর্ম করি।
বিকেল ৪টায় জেলা শিশু একাডেমিতে যাই। সেখানে দিনভর উদ্যাপিত জাতীয় শিশু প্রতিযোগিতায় বিজয়ী প্রতিযোগীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করি। শিশুদের প্রতিযোগিতা নিয়ে আবেগ-উচ্ছাস দেখে নিজের ভেতরেও যেন একটা শিশুমন নেচে ওঠে।
সন্ধ্যা ৬টায় আরডি হল মাঠে প্রাক্তন খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির ব্যবস্থাপনায় প্রবাসী মোহাম্মদ সেলিমের উদ্যোগে আয়োজিত ‘আনিকা ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান করি। জেলার প্রাক্তন ও বর্তমান নামিদামি খেলোয়াড় ও ক্রীড়ামোদী সুধীবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। তালিকাভুক্ত বাডমিন্টন খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর আজকের প্রতিযোগীদের মধ্যে খেলার বাঁশি বাজিয়ে খেলা উদ্বোধন করি। এরপর আমি সেখান থেকে টেনিস মাঠে গিয়ে নিজে টেনিস খেলে বাসায় ফিরে আসি।
২১ জানুয়ারি ২০০৮, সোমবার। গত রাতে শীত মৌসুমের বৃষ্টি ঝরেছে। সকালে বৃষ্টি না থাকলেও আকাশটা মেঘলা। আমার আজ পুরাতন লাখাই এলাকায় অবস্থিত এসিআরসি হাইস্কুলে ছবিসহ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদানের কর্মসূচি রয়েছে। আমি সকাল সাড়ে আটটায় লাখাইয়ের উদ্দেশে রওনা করি। নতুন লাখাই (কালাউক) হেডকোয়ার্টার পেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরই কাঁচা রাস্তা। গতরাতে বৃষ্টির কারণে গাড়ি চলতে বেশকষ্ট হয়। শেষমেশ সাড়ে ১০টার পর উক্ত হাইস্কুলে গিয়ে পৌঁছি। স্কুলের মাঠে প্যান্ডেল টানিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এলাকার লোকজন জড়ো করেছেন। অনুষ্ঠানে ইউএনও লাখাই, ওসি ও সেনা ইউনিটের এ উপজেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার মেজর জাবেদ উপস্থিত ছিলেন। আমাদের বক্তৃতার পালা শেষ হলে ফিতা কেটে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রমের উদ্বোধন করি। আমার বক্তব্যে এলাকার সকল ভোটার হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেন্দ্রে এসে ভোটার তালিকায় নাম রেজিস্ট্রেশন করার জন্য আহ্বান জানাই। আর কেউ একাধিক স্থানে ভোটার হলে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে বলেও সতর্কবার্তা দিই। লাখাই থেকে বেলা ১টায় আমার অফিসে ফিরে আসি।
২২ জানুয়ারি ২০০৮, মঙ্গলবার। আজ সকাল ১০টায় হবিগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজনে জালাল স্টেডিয়ামে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগের উদ্বোধন করি। হবিগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে একসময় বেশ উত্তপ্ত থাকত। এখন খেলাধুলা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হওয়ায় সেই উত্তপ্তভাব ক্রীড়া উত্তেজনায় রূপান্তর হয়েছে। খেলার মাঠে দর্শক বেড়েছে কয়েক গুণ। এটা একটা ভালো লক্ষণ বলে হবিগঞ্জের অনেকেই বলাবলি করেন। (চলবে…)