প্রবাসীদের সম্পত্তির রক্ষকগণের মধ্যে অনেক ভুরিভুরি ভক্ষক আছে

ভক্ষকদের মিথ্যা মামলার কারণে অনেকেই দেশে আসেন না। দেশের টানে কেউ কেউ দেশের বিমানবন্দরে এসে নামার পর যখন জানতে পারেন, তাঁদের নামে ফৌজদারি মামলার ওয়ারেন্ট জারি রয়েছে, তখন তাঁদের অনেকেই আবার সেখান থেকেই ফিরে যান ॥ কর্ণেল মনির ও এসপি মান্নানসহ আমি বসে শায়েস্তাগঞ্জ রেলজংশনের পার্কিংলট এলাকা থেকে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেই

আতাউর রহমান কানন

১০ মার্চ ২০০৭, শনিবার। সাপ্তাাহিক ছুটির দ্বিতীয় দিন। নাশতার পর বাসভবনের অফিসে কিছু জরুরি কাজ করছিলাম। এমন সময় নবীগঞ্জ উপজেলার দুজন লন্ডন প্রবাসী আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তাঁরা আমার পূর্বপরিচিত নন। তাঁদের সাথে কুশল বিনিময়ের পর তাঁদের একজন জানান যে, দেশে এসে দেখেন তাঁর কেয়ারটেকার অন্যের যোগসাজসে তাঁর জমিজমা আত্মসাৎ করে ফেলেছে। তিনি আইনি ব্যবস্থার কথা জানালে উল্টো সে তাঁর বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা দিয়েছে। এখন বাড়িতেই থাকতে পারছেন না; তিনি এর একটা প্রতিকার চান।
আমি তাঁকে ভালো করে শুনে বুঝলাম, তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ ধারার শান্তিভঙ্গের অভিযোগ কোর্টে দায়ের হয়েছে। প্রবাসী এতেই ভেঙে পড়েছেন। তাঁকে অভয় দিয়ে বললাম, মামলার অভিযোগ তেমন না। আপনি কোনো ভালো উকিল ধরে কোর্টে হাজিরা দিন। কোর্ট আপনাকে শুনে প্রয়োজনীয় আদেশ দিবেন। এখানে আমার হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই।
প্রবাসীদের চা খাইয়ে বিদায় দিলাম। এলাকায় প্রবাসীদের এমন সমস্যা অনেক। আমার অভিজ্ঞতায় আমি এমন অনেক শুনেছি, জেনেছি। প্রবাসীদের সম্পত্তির রক্ষকগণের মধ্যে এমন ভুরিভুরি ভক্ষক আছে। ভক্ষকদের মিথ্যা মামলার কারণে অনেকেই দেশে আসেন না। দেশের টানে কেউ কেউ দেশের বিমানবন্দরে এসে নামার পর যখন জানতে পারেন, তাঁদের নামে ফৌজদারি মামলার ওয়ারেন্ট জারি রয়েছে, তখন তাঁদের অনেকেই আবার সেখান থেকেই ফিরে যান।
সন্ধ্যে ৭টায় হবিগঞ্জ প্রেস ক্লাবে যাই। সেখানে কবি তাসলিমা খানের ‘মেঘের ঠোঁটে রোদ’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখি এবং গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করি।
১১ মার্চ ২০০৭, রবিবার। ৯টায় অফিসে গিয়ে কিছু কাজকর্ম সেরে জেলা সদরের এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রসমূহ পরিদর্শন করি। বিকেল ৪টায় নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জে বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে যাই। প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের আগমন উপলক্ষ্যে নির্মাণাধীণ হেলিপ্যাডের কাজের অগ্রগতি দেখি। সেখান থেকে আমার প্রোটোকলে আসা ইউএনও-সহ ইনাতগঞ্জ ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যাই। ভূমি অফিস পরিদর্শন শেষে সন্ধে সাড়ে ৬টায় সদরদপ্তরে ফিরে আসি। সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বাসভবনের অফিসে অফিস করে দিনের রুটিন কাজ শেষ করি।
১২ মার্চ ২০০৭, সোমবার। সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে পরপর ৭টি সভায় সভাপতিত্ব করি। বিকেল আড়াইটায় আমার দীর্ঘদিনের অর্ডালি এমএলএসএস শওকত আলির ছেলের বউভাতে যোগদান করি। এ জেলায় আমি ১৯৯২-৯৭ সালে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও এনডিসি থাকাকালে শওকত আলি আমার অর্ডালি ছিল। অফিস-বাসার কাজকর্ম করা ছাড়াও আমার পুত্র-কন্যার খেলার সাথি ছিল। তার বিশ্বস্ততা ও দায়িত্ববোধের কারণে এবার জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি হবিগঞ্জে ফিরে আসার পর তাকে আমার বাসভবনের অর্ডালি হিসেবে নিয়েছি।
সন্ধ্যার পর বাসভবনের অফিসে ফাইলের কাজ করছিলাম। এর মধ্যে দুর্নীতি কমিশনের সিলেট অঞ্চলের ডিডি নাসির উদ্দিন আসেন। তিনি আমার সঙ্গে কিছু অফিসিয়াল আলাপ করে চলে যান। আমার কাজ সেরে আজ বিছানায় যেতে যেতে রাত সাড়ে ১২টা বেজে যায়। আমি আর্লি রাইজার হওয়ায় সাধারণত ১১টা- সাড়ে ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। বর্তমান পদে যোগদান করার পর তা আর নিয়মিত হচ্ছে না।
পরের দিন সকালে অফিস হয়ে ১০টায় বাহুবল উপজেলার অন্তর্গত আলিফ-সোবহান ডিগ্রি কলেজের গভর্নিং বডির সভায় সভাপতি হিসেবে যোগদান করি। সভা চলার একপর্যায়ে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ফজলুর রহমান চৌধুরীর এক বক্তব্যের কারণে সভার পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আমার কাছে বক্তব্য শালীন বলে মনে না হওয়ায় আমি সভা স্থগিত করে বাহুবল উপজেলায় চলমান এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে চলে যাই। বিকেল আড়াইটায় নিজ অফিসে ফিরে আসি। লাঞ্চের পর সদর উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে গিয়ে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বেসিক কোর্সে বক্তব্য রাখি।
বেশ কয়েকদিন পর আজ টেনিস খেলায় হাজিরা দিই। হবিগঞ্জের জালাল স্টেডিয়াম সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী শিরিষতলা এলাকার জমজমাট টেনিস ক্লাব আমাকে প্রতিদিনই টানে; কিন্তু নানা ব্যস্ততার কারণে নিয়মিত যাওয়া হয় না। আজ টেনিস খেলে রাত সাড়ে ৯টায় বাসায় ফিরে আসি।
১৫ মার্চ ২০০৭, বৃহস্পতিবার। সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে সারাদিন বেশ ব্যস্ততার মধ্যে কাটাই। প্রধান উপদেষ্টার হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে আগমন সময় ঘনিয়ে আসায় প্রস্তুতিমূলক কাজকর্মে সময় দ্রুত কেটে যায়। এরমধ্যে ভিজিটর তো আছেই। তাঁদের সাক্ষাৎ না দিলেও চলে না। অফিসের কাজ সেরে বাসায় ফিরতে আজ রাত আটটা বেজে যায়।
আজ রাতের টিভি সংবাদে দেখলাম, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। দেশে বর্তমানে জরুরি অবস্থা বলবৎ থাকায় রাজনীতির অঙ্গনে যেন বরফযুগ চলছে। আর রাজনীতিবিদরা শীতনিদ্রায় আছেন। এমন অবস্থায় যেখানে যার সুবিধা সেখানেই অবস্থান করবেন- এটাই তো স্বাভাবিক।
১৬ মার্চ ২০০৭, শুক্রবার। সকাল ১০টায় আমার বাসভবনে অনুষ্ঠিত কোর্ট মসজিদের নির্মাণ উপকমিটির সভায় যোগদান করি। কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত হই। ১১টায় সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির ও এসপি মান্নান আমার বাসভবনে আসেন। আমরা জেলার আইনশৃঙ্খলা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কিছু জরুরি সিদ্ধান্ত নিই। এরমধ্যে কর্নেল মনির এক পর্যায়ে হবিগঞ্জ শহরের চৌধুরীবাজার এলাকার যানজট ও শায়েস্তাগঞ্জ রেলজংশনের পার্কিং সমস্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন যে, শহরের যানজট নিরসনের জন্য ওই এলাকার রাস্তা প্রশস্ত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নাই। আর শায়েস্তাগঞ্জে এত সুন্দর একটি রেল টার্মিনাল হয়েছে, অথচ অবৈধ দোকানদারদের কারণে যাত্রীরা এর সুফল পাচ্ছেন না। টার্মিনালটির পার্কিংলট এলাকা পরিষ্কার করা দরকার।
আমি বললাম, চৌধুরীবাজার একটি পুরাতন বাজার, ওই এলাকাকে ঘিরেই হবিগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্য। সমস্যাটি পুরোনো ও জটিল। আর রেলজংশনের পার্কিংলটের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ তেমন জটিল না। তবে আইনিপথে হাঁটলে কাজগুলো দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ। এছাড়া কেউ যদি মামলা করে তো বাস্! সব আটকে যাবে।
এসপি সাহেব আমার সাথে একমত হয়ে বললেন, অনেক দোকানঘর ভাঙা পড়বে। তবে আমরা সামাজিকভাবে বুঝিয়ে যতটা পারি তা করতে পারি। এ ব্যাপারে ডিসি মহোদয় উদ্যোগ নিতে পারেন।
কর্নেল সাহেব বললেন, তা পারেন, তবে আমি চাই চলাচল স্মুথ করতে যা লাগে তা করা দরকার। আমার তরফ থেকে ফুল সাপোর্ট থাকবে।
আমি কর্নেল সাহেবের ইচ্ছাকে স্বাগত জানিয়ে বললাম, আমি একমত। তবে সামনে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিবিয়ানায় প্রোগ্রাম রয়েছে, সেটা পার করে আমরা অগ্রসর হই।
কর্নেল সাহেব বললেন, দ্যাট’স ফাইন।
এসপি ও কর্নেল চলে গেলে আমি ভাবলাম- কাজগুলো গায়ের জোরেই করতে হবে। কেউ স্বেচ্ছায় একবিন্দু জায়গাও ছাড়বে না। দেশের বর্তমান জরুরি অবস্থা, সামরিক শাসনের চেয়ে তেমন একটা কম না। দেশজুড়ে এদের তৎপরতায় সবাই এখন ইয়া-নাফছি ইয়া-নাফছি অবস্থায় আছেন। এ সুযোগেই এসব জটিল কাজ একে একে সারতে হবে।
আজও বিকেল ৫টায় বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে যাই। সেখানে প্রধান উপদেষ্টার আগমন উপলক্ষ্যে প্রস্তুতি কাজকর্ম দেখি। এরপর সন্ধ্যে ৭টায় এসএসএফ ও অন্যান্য সংস্থা-দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় সভা করে রাত সাড়ে ৯টায় বাসায় ফিরে আসি।