এসএম সুরুজ আলী ॥ হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মদিনাতুল কুবরা জেরিন হত্যা মামলার আসামী রুবেল মিয়ার জামিন আবেদন হাইকোর্টে নামঞ্জুর করা হয়েছে। মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি এসএম কদ্দুছ জামান ও বিচারপতি একেএম রবিউল হাসানের সমন্বয় বেঞ্চ রুবেল মিয়ার জামিন নামঞ্জুর করেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেন রাষ্ট্রেরপক্ষের আইনজীবী সহকারি এ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ আহমেদ হিরু।
বাদীপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ব্যারিস্টার রুহুল আমিন মোল্লা মিহন। তিনি আশা প্রকাশ করেন এই মামলায় বিচারিক আদালত জাকির হোসেন ও নূর আলম নামে দুই আসামীকে মৃত্যুদন্ডের যে রায় দিয়েছিলেন, তা উচ্চ আদালতে বহাল আছে। শিশু আদালতে চলমান বিচারে কারাবন্দী রুবেল মিয়ার জামিন এর আগেও নামঞ্জুর করেছিলেন হাইকোর্ট। ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৩টায় র‌্যাব-৯ এর একটি টিম বিশেষ টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে রুবেল মিয়াকে আটক করে। রুবেল মিয়া ধল গ্রামের মৃত রহমত আলীর ছেলে।
র‌্যাব সূত্র জানায়, রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মদিনাতুল কুবরা জেরিন নিহত হওয়ার পর থেকে আটককৃত রুবেল মিয়া পলাতক ছিল। সে নাম পরিবর্তন করে মাসুদ রানা নামে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী করে দিরাইয়ে শান্তিপুর গ্রামে আশ্রয় নেয়। নিজের নাম রুবেল মিয়া হলেও সেখানে মাসুদ রানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১০ অক্টোবর রাতে যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে রুবেল মিয়া সেই বাড়ির এক মেয়ের সাথে তার বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে বিকেল সাড়েটায় রুবেল মিয়া ও তার হবু স্ত্রীর হাতে গায়ে হলুদের মেহেদী পড়ানো অবস্থায় র‌্যাব রুবেল মিয়াকে আটক করে।
মামলার বিরবণে জানা যায়, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের আব্দুল হাই’র মেয়ে এবং রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০২০ সালের এসএসসি পরিক্ষার্থী মদিনাতুল কুবরা জেরিনকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল একই গ্রামের জাকির হোসেন। কিন্তু জেরিন তার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে প্রায় সময় উত্ত্যক্ত করতো জাকির। এই বিষয়টি জেরিনে বাবা জাকির হোসেনের পরিবারকে অবগত করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জেরিনকে অপহরণ পরিকল্পনা করেন জাকির। ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নূর আলমের সিএনজি অটোরিক্সায় করে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল জেরিন। আগে থেকেই গাড়িতে ছিলেন রুবেল। পথিমধ্যে সিএনজি অটোরিক্সাতে তোলা হয় জাকিরকে। সিএনজি অটোরিক্সাটি জেরিনের স্কুল পেরিয়ে গেলেও তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়নি। এ সময় নামার চেষ্টা করলে জেরিনের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু হয় অপহরণকারীদের। এক পর্যায়ে সিএনজি অটোরিক্সা থেকে জাকির তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। এতে জেরিনের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ জানুয়ারি সকালে মারা যান জেরিন। প্রথমে এ ঘটনা দুর্ঘটনা বলে প্রচার করা হলেও পরবর্তীতে পুলিশ এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ জাকিরকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে ৩০ জানুয়ারি আদালতের নির্দেশে কবর থেকে জেরিনের লাশ উত্তোলন করে ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়। এর আগে জেরিনের বাবা আব্দুল হাই বাদী হয়ে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ প্রেক্ষিতে মামলার প্রধান আসামী জাকির হোসেন ও নূর আলমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জাকির হোসেন ও নূর আলম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার তথ্যকালীন ওসি মাসুক আলী ২০২১ সালের ১৮ মার্চ আদালতে জাকির হোসেন, নূর আলম ও রুবেল মিয়ার বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেন। এ মামলায় ২১ জনের সাক্ষ্য গ্রহন করা হয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর আসামী জাকির হোসেনের উপস্থিতিতে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক সুদীপ্ত দাশ জেরিন হত্যা মামলায় দুই আসামীর ফাঁসির আদেশ দেন। একই সাথে তাদের দেড় লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। দন্ডপ্রাপ্তরা হলেন-হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের দিদার হোসেনের ছেলে জাকির হোসেন (২৫) ও পাটলী গ্রামের আব্দুল হাইয়ের ছেলে সিএনজি চালক নূর আলম। মামলার অপর আসামী রুবেল মিয়া ঘটনার সময় অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় শিশু আদালতে তার বিচারকার্য চলমান রয়েছে। রায়ের কিছুদিন পর ওই মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী সিএনজি অটোরিক্সা চালক নূর আলম আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।